বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৩৯ পূর্বাহ্ন

কৃষ্ণগোপাল রায়: এক অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার অজানা তথ্য-মুকুল রায়

কৃষ্ণগোপাল রায়: এক অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার অজানা তথ্য-মুকুল রায়

কৃষ্ণগোপাল রায়: এক অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার অজানা তথ্য
মুকুল রায়

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ করে সদ্যস্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হলেন। ক্ষমতায় এলেন মেজর জিয়া।
জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট। তিনি কারমাইকেল কলেজ ভিজিট করতে আসবেন। কৃষ্ণ গোপাল রায় আগের রাতে বাড়িতে এসে হাজির। তিনি কারমাইকেল কলেজের বাংলার শিক্ষক। নবীন শিক্ষক। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকুরী নেয়া ৭৩ বিসিএস শিক্ষক।
এই কারমাইকেল কলেজেরই ছাত্র ছিলেন তিনি। ছিলেন ছাত্রসংসদের সদস্য এবং ম্যাগাজিন ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক। সেই সত্তুরের নির্বাচনে গ্রামে গঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে ক্যানভাস করে বেড়িয়েছেন দিনরাত একাকার করে। তার এলাকা লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম-ফুলবাড়ী হিন্দু প্রধান এলাকা! এই নির্বাচনী এলাকার সেই সময়ে প্রায় ৬০% ভোটার হিন্দু।
লালমনিরহাট-ফুলবাড়ি-কুড়িগ্রাম নির্বাচনী এলাকার তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় সংসদের বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের এম,এন,এ পদ প্রার্থী আহমেদ আলী তার সন্তানের হঠাৎ মৃত্যুজনিত কারণে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পর সবাই আশা করছিলেন যে, বৃটিশ আমল থেকে পুরুষানুক্রমিকভাবে তৈরি প্রভাব-প্রতিপত্তির বলয় ব্যবহার করে এমনকি তার নগদ অর্থকড়ি খরচ করেও পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়ন জেল-জরিমানার হাত থেকে নেতাকর্মীদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত কুড়িগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি অবাঙালি মাড়োয়ারি সঞ্জীব করঞ্জাই বাবুকেই বঙ্গবন্ধু নমিনেশন দিবেন।
কিন্তু বাস্তবে যখন তাকে না দিয়ে বঙ্গবন্ধু তার পরিবর্তে তৎকালীন এলাকার মুসলিম লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ভোলা মিঞাকে নমিনেশন দিলেন, তখন সঞ্জীব করঞ্জাই মনক্ষুণ্ণ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং এলাকার সমস্ত হিন্দু ভোটারদের ভোট সংগ্রহ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন, নিজে একজন হিন্দু হিসেবে অন্য হিন্দুদের ভোট প্রার্থনা করে বেড়াতে লাগলেন। শেষদিকে এলাকার ভোটে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে গেল যে, নৌকার প্রার্থী ভোলা মিয়ার হেরে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নাই।
এই পরিস্থিতিতে এম,এন,এ প্রার্থী ভোলা মিয়া এবং এম,পি প্রার্থী আবুল হোসেনের অনুরোধে কৃষ্ণগোপাল কারমাইকেল কলেজ ছেড়ে তার সঙ্গীসাথী নিয়ে তার এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। তিনি ভোটের পরিস্থিতি এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে এলাকায় তার প্রভাবশালী পিতাকে সাথে নিয়ে হিন্দু ভোটারদের বোঝানোর জন্য মাঠে নেমে পড়লেন। তিনি ‘৭০এর ভোট মানে সাধারণ ভোট নয়, বাংলার স্বাধীকার তথা ‘স্বাধীনতা’র ভোট’, বাংলার মানুষের মুক্তির ভোট- এই বিষয়টি বোঝাতে দিনরাত কাজ করা শুরু করে দিলেন। তিনি বাড়িবাড়ি, পাড়ায় পাড়ায় ‘খোলান-বৈঠক’ করে হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষকে এই মর্মে বোঝাতে শুরু করলেন যে, করঞ্জাই বাবুকে ভোট দিলে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় একজন ‘হিন্দু এম এন এ’ পাবেন বটে, কিন্তু নিজের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ‘স্বাধীনতা’ বা ‘স্বাধীন দেশ’ পাওয়া যাবে না। এমতাবস্থায় সকল হিন্দুদের শুধু নয়, দেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রার্থীকে সকল বাঙালির ভোট দিতে হবে। এই ভোটে প্রার্থী সঞ্জীবকরঞ্জাই কিংবা ভোলা মিঞা নয়, এই ভোটে প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর নৌকা! বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে ভুল করে যদি কলাগাছকে দাঁড় করিয়ে দেন, তবুও বাংলার স্বাধীনতার জন্য প্রতিটি বাঙালিকে সেই কলাগাছকেই ভোট দিতে হবে। এই ঐতিহাসিক ভোট দিতে একবার ভুল করলে বাংলা আর স্বাধীন হতে পারবে না, বাঙালিদের বংশ-পরম্পরায় অবাঙালি পাকিস্তানিদের পরাধীন হয়ে থাকতে হবে।
এভাবেই এলাকার প্রচন্ড প্রভাবশালী তার পিতাকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে এবং তিনি নিজেও তার দলবলসহ দিনরাতের প্রচণ্ড পরিশ্রমের ফলে সত্তরের নির্বাচনে এই কুলাঘাট সেন্টারে শতকরা ১০০ ভাগ ভোটসহ পুরো নির্বাচনী এলাকায় এক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগের এম,এন,এ এবং এম,পি পদের আওয়ামী লীগের নৌকা-মার্কার প্রার্থীরা। পাকিস্তানপন্থী সমস্ত নির্বাচনী কর্মকর্তার সবরকম তদারকিতে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী প্রার্থীর বাক্সে একটি ভোটও পড়লো না কুলাঘাট সেন্টারে! এভাবেই তৎকালীন লালমনিরহাট-ফুলবাড়ি-কুড়িগ্রাম নির্বাচনী এলাকার সত্তুরের ঐতিহাসিক এই রায় বাংলাদেশের নির্বাচনে তৈরি করল ইতিহাসের এক নতুন মাত্রা।
তার এই একান্ত ও অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতিদান দিল আওয়ামী লীগ- গোটা রংপুর অঞ্চলের সকল এমপি-এমএমএ মিলে লালমনিহাট মডেল হাই স্কুল মাঠে এক বিশাল জনসভায় সংবর্ধনা দেয়া হল কৃষ্ণ গোপাল রায়কে, তাকে সম্বর্ধিত ও সম্মানিত করা হলো সোনার-নৌকা উপহার দিয়ে।
এরপরে ২৫ শে মার্চের রাতে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর মার্চের শেষের দিকে লালমনিরহাটের আট দশজন ছাত্রযুবাকে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করে সে তাদেকে সাথে করে জীবনের রিস্ক নিয়ে বর্ডার ক্রস করে গীতালদহ দিয়ে চলে গেলেন দিনহাটায়। শুন্য হাতে সেখানে গিয়ে সেখানকার এম এন এ ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির নেতা কমল গুহের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং কমল গুহের সহায়তায় দিনহাটা-কুচবিহার এলাকায় গড়ে তুললেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ক্যাম্প। কৃষ্ণগোপাল হলেন লালমনিহাট-দিনহাটা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক।
স্বাধীনতার পর লালমনিরহাটের কিছু সংখ্যক লোক যখন চোরাচালান করে টাকা পয়সা আয় করে বড়লোক হওয়ার ধান্দা শুরু করলেন, তৎকালীন কারমাইকেল কলেজের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে এই কৃষ্ণগোপাল রায় লালমনিরহাটের এই চোরাচালান প্রতিরোধে নেমে পড়লেন এবং একপর্যায়ে এই চোরাচালান বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু চোরাচালান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হলো। তার পিতা তাকে বাঁচাতে তাকে প্রায় জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন লালমনিরহাটের বাইরে।
এই মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ গোপাল রায় প্রচন্ড জেদী, একরোখা এবং দূর্বিনীত। তার পিতা হাড়ে হাড়ে চেনেন তাকে। তিনি জিয়াউর রহমানের রংপুর কারমাইকেল কলেজের আসার বিষয়টি জানেন। তিনি স্পষ্ট বুঝলেন যে, জিয়াউর রহমানকে পছন্দ না করার জন্যই কলেজ ছেড়ে কৃষ্ণগোপাল চলে এসেছে বাড়িতে।
তাই তিনি না ঘাটিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলেন- ‘কি কৃষ্ণ, জিয়া কলেজ ভিজিটে আসবে, আর তুমি কলেজ ছেড়ে চলে এলে? এটা কি ঠিক হলো?’
কৃষ্ণগোপাল উত্তর দিলো- ‘কেন ঠিক হবে না? বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে, তারা কি ঠিক করেছ?’
‘কিন্ত, জিয়া তো এখন প্রেসিডেন্ট…’
‘এক অবৈধ অনির্বাচিত হায়ার সেকেন্ডারি পাশ সামরিক শাসককে আমি প্রেসিডেন্ট মানি না।’
‘চাকরিতে কোন সমস্যা হয় কিনা..’
‘আমার চাকরীতে সমস্যা হোক, চাকুরী থাকুক না থাকুক, বঙ্গবন্ধুর রক্ত লেগে আছে যে হাতে, সেই হাতের সাথে আমি হাত মেলাতে পারি না, হাত মেলাব না, আমার কপালে যাই থাক….’
এলাকার সমাজ-সংস্কারক, তার এলাকা তথা পূর্ববঙ্গে প্রথম বিধবা-বিবাহ প্রদানকারী, এলাকার নারী শিক্ষার অগ্রদূত, মুক্তচিন্তার ব্যক্তিত্ব পিতা গোবিন্দ চন্দ্র রায় তার প্রচন্ড জেদী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অবিচল তার এই সন্তান কৃষ্ণগোপালকে ভালোভাবে জানেন। স্বাধীনতার পরপরই সেই দিনগুলোতে অসংখ্য শুন্যপদের বিপরীতে পুলিশের পদসহ আরও বেশকিছু লোভনীয় পদে নিয়োগপত্র পাবার পরেও কোন পদেই যোগদান না করে শুধুমাত্র যোগদান করেছেন শিক্ষা ক্যাডারে। তাই তিনি নীরব থাকলেন তার সন্তানের এই একরোখা জেদে।
সরকারি চাকুরে হয়েও একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু হত্যার সরাসরি বেনিফিশিয়ারি দেশের অনির্বাচিত এক প্রেসিডেন্টের সাথে এভাবেই তার করমর্দন করার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন…! এই রকম দুর্দান্ত সাহসের উদাহরণ বোধহয় ইতিহাসে বিরল!

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge