বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:০৮ পূর্বাহ্ন

কানাডার টরন্টো থেকে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৪

কানাডার টরন্টো থেকে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৪

কানাডার টরন্টো থেকে
বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী
করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৪

আশা ও নিরাশার গল্প
এখন রাত দিন সবই সমান। কোনোও পার্থক্য বিশেষ নেই আমার কাছে। বাইরের দিকে তাকালে এই পৃথিবী খুউব অচেনা লাগে। এইরকম পৃথিবী কেউ চায়নি। ঘরে আছি বলে ক্ষনে ক্ষনে পত্রিকার পাতায় না হয় ফেসবুকে চোখ যায়। ফেসবুক মানেই দুঃসংবাদ, ফেসবুক মানেই মৃত্যুর খবর, ফেসবুক মানেই লাশ। এতো এতো মৃত্যু আগে কেউ দেখেনি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানেই মুহূর্তে খারাপ খবরগুলো পৌঁছে যাচ্ছে। মনের উপর চাপ তৈরী হচ্ছে। প্রচন্ড চাপ। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছাব আমরা জানি না। এতো চাপ সহ্য করতে পারব কিনা তাও জানা নাই। এক ধরণের ট্রমায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সহজেই এ থেকে মুক্তি পাব না আমরা। মানুষ শোকে পাথর হয়ে গেছে। যদি বেঁচে বর্তে যাইও এরপর স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও মানুষ আর চোখের জল ফেলবে না, দুঃখ পাবে না। দুঃখের বোধগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চোখের জল শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
ঘরে আছি বলে যে কিছু করতে পারছি তা না। লিখতে পারি না, মাথার মধ্যে কোনো লেখা কাজ করে না, বই নিয়ে বসি প্রতিদিন। অসংখ্য বই অপঠিত রয়ে গেছে। সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করি। কিছুদূর পড়ে আবার রেখে দেই। বইয়ের গভীরে যেতে পারি না। রসাস্বাদন করতে পারি না। মুভি দেখি কিন্তু দেখার জন্য দেখা। জেসমিনের সাথে স্বাভাবিক সময়ে দিনে একবার হলেও খটাখটি হতোই, সেটাই ছিল স্বাভাবিক, জীবনের স্পন্দন বোঝা যেতো। জীবন যে চলমান আছে বোঝা যেতো। ঝগড়া হতো আবার নিজেই গায়ে পড়ে কথা বলতাম, যেনো কিছুই হয়নি। এখন তাও হয় না। ঢাকা থেকে এসেছি প্রায় বাইশ দিন অথচ আশ্চর্য্য, দারুণ সহাবস্থান করছি। কোনো কনফ্রন্টেশন নাই। এক বাসায়ই আছি কিন্তু মনে হচ্ছে আমি যেনো জেসমিনের ভাশুড়!
রাতে যতটা সম্ভব বেশি ঘুমিয়ে নেই। ঘুমের মধ্যে যতক্ষণ থাকি ততক্ষনই মুক্তি। নয় দশ ঘন্টা ঘুমাই টানা। অথচ নর্মালি আমি সাত ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারি না। পিঠ ব্যাথা হয়ে যায়। আমি এমনিতেই ব্যাকপেইনে ভুগি সারা বছর। ফেসবুক খুললে বেশিরভাগই নিউইয়র্কের খবর। সেখানে আমাদের অনেক বন্ধু আত্মীয়রা রয়েছে। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর খবর আসছে। বাংলাদেশ থেকেও খারাপ খবর বাড়ছে প্রতিদিন। দেশে যার সাথেই কথা বলি সেই একটা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আমার অনেক পরিচিতজনরা দেশে আটকা পড়েছে, ফিরতে পারছে না।
তবে আশার কথা হচ্ছে এই দুর্যোগ কেটে যাবে। ক্রমান্বয়ে ভলোর দিকেই যাচ্ছে। কানাডার খবরও ভাল। ততদিন সাবধানে থাকুন, ঘরে থাকুন। আবার হবেতো দেখাৃ
টরন্টো ১৫ এপ্রিল ২০২০
শুভেচ্ছা ও শোক
এমন বৈপরীত্য আগে কে কবে দেখেছে! এমন অদ্ভুত সময় পৃথিবীতে আর কি এসেছে! প্রতিদিন অনেককে আমরা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই এবং একই সাথে অনেকের মুত্যুতে শোক প্রকাশ করি। শুভকামনা এবং শোক হাত ধরাধরি করে চলছে। একবার আনন্দ প্রকাশ করি পরমুহূর্তেই বেদনার্ত হই, একবার হাসি পরক্ষনেই চোখের জল ফেলি। মানুষ বলেই একই সাথে দুই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি। পশুদের এই সমস্যা নাই। তবে পার্থক্য হচ্ছে জীবিত মানুষ শুভেচ্ছার জবাব দিতে পারে, মৃত মানুষ তা পারে না,সে সব কিছুর উর্ধ্বে চলে যায়। কিন্তু তার আত্মা শান্তি পায় নিশ্চয়ই!
টরন্টো ১৮ এপ্রিল ২০২০
ডব জোহার
সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিসট্যান্স নতুন কিছু নয়। আজকে বিজ্ঞান যা বলছে, হাজার বছর আগেই তা পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন। অতিথি আপ্যায়নে এই প্রথা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক। আগের দিনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, লোটাদা করে জীবানু নাশক হয়ে তবেই গৃহে প্রবেশের নির্দেশ ছিল। আদিবাসী স¤প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব একটি প্রচলিত পন্থা। আদিবাসীদের বাড়িতে অতিথি এলে তাকে বাড়ির বাইরে দড়ির খাটিয়া, মাচুলি বা চেয়ারে বেশ কিছুক্ষন বসতে দেওয়া হয়। তারপরে কাঁসার বাটিতে জল এনে তাকে হাত পা ধুতে দেওয়া হয়। যাকে বলে লেটাদা। ঘরের বাইরে জুতা স্যান্ডেল রেখে আসতে হয়। অতিথি বয়স্ক হলে তাকে প্রণাম করে দূর থেকে। ছোটরাও বড়দের প্রণাম করে দূর থেকে। বিজ্ঞান এখন এই আদিম পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। এটা এক ধরণের লক ডাউন। এটাকে বলে ডব জোহার।
টরন্টো ১৯ এপ্রিল ২০২০
একটি স্মৃতিকথা এবং বর্তমান বাস্তবতা
রিমন আমার চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের ছোট। সম্পর্কে আমার ছোট ভাই। বয়সে ছোট হলেও আমাদের সখ্যতা হতে কোনো সমস্যা হয়নি। দারুণ মাখামখি ছিল আমাদের। বয়স কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা একসাথে খেলতাম, ঘুড়ি উড়াতাম, নারকেল আৱ খেজুরের রস পেড়ে খেতাম, আমাদের পাশের বাড়ির খোয়াৱ থেকে মুরগি চুৱি কৱে বনভোজন করতাম বাড়িতে। আমাদের মল্লিক বাড়ি, রিমনের মামা বাড়ি। বরশিাল শহরেই ওদের বাসা হলেও বেশিরভাগ সময় মামা বাড়িতেই কাটত ওর। আমি আর রিমন বাড়িতে তিন তলাৱ চিলেকোঠায় থেকেছি অনেকদিন। বি এম কলেজে পড়ি।
তখন থেকেই আমি এক আধটু লিখতে শুরু করেছি। বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব করি। বিভিন্ন পত্রিকায় চিঠিপত্র এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন লিখি। সে সময় পঞ্চপান্ডব, তসলিমা নাসরিন, রফিকুল্লাহ এমরান (ইমু), মরমিড, মাসুদ(এমকো),পাহাড়ি কুমার, জিয়া খন্দকার, শিউ সুবর্ণগ্রাম, রজনী, লিয়াকত হোসেন খোকন সহ আরো অনেকে বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিত। আজকের ফেসবুকের মতোই সেটা ছিল জনপ্রিয় চ্যাটবক্স। তখন আমার অনেক পেনফ্রেন্ড ছিল। প্রতিদিন গন্ডা গন্ডা চিঠি আসে আমার কাছে। কখনো কখনো মেয়েরা চলে আসে বেড়াতে আমাদের বাড়িতে।
কলেজে মেয়েরা আমাকে ঘিরে থাকে। পাঁচ ছয় জন মেয়ের মধ্যখানে আমি। এর মধ্যে একটি মেয়ে আমার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট। আমার ক্লাসেরই। আমাকে দৈনিকবাংলা থেকে পেপাড় কাটিং এনে দেয়। গল্প, উপন্যাস পড়তে দেয়। নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনী, আশুতোষ, বিমল মিত্র, শঙ্কর, আশাপূর্ণা, নিমাই এঁদের বই। কখনো কখনো বইয়ের মধ্যে চিঠিও থাকে। দারুণ সব চিঠি। বুদ্ধিদীপ্ত চিঠি। সেই চিঠিতে কখনো প্রেমের কথা থাকে না। আমিও রিপ্লাই দেই।
কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছে, কলেজে আসাৱ জন্য আমার যথেষ্ট ভাল কাপড় চোপড় নাই। এক দুইটা প্যান্ট বা শার্ট, একজোড়া জুতা পড়ে প্রতিদিন কলেজে আসতে কেমন লাগে না! মেয়েরাই বা কি ভাববে! সুন্দর সুন্দর সব মেয়ে। রিমনের তখন থেকেই একটা ব্যাপার ছিল। ভাল ভাল কাপড় পড়ত। দেখতেও সুদর্শন। আমি করতাম কি, রিমনের শার্ট,গেঞ্জি পড়ে কলেজে আসতাম। সাইজ ঠিক ছিল না কিন্তু টেনে হিচরে পড়তাম। কেউ বুঝত না।
কালকে রিমনের ফোন পেলাম ম্যাসেঞ্জারে। দু’বার ফোন করেছে কিন্তু ধরিনি। ভাবলাম সুবিধামতো সময়ে করবনে। আমার একটা সমস্যা আছে। সমস্যা বিৱাট। সেটা হচ্ছে ফোনে কথা চালাচালিতে আমি একদম পটু না। মানুষের সাথে আমার বেশি কথা থাকে না। অনেক দরকারি ফোনও আমি করি না। অনেকে আছে বিরামহীন কথা বলতে পারে। কোনো ক্লান্তি নাই। যেমন জেসমিন। আসলে যুগটা হচ্ছে কমিউনিকেশনের। আমার যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ বলে আমার কিছু হয় না। আমার আৱো সমস্যা আছে, দু’চার কথা বলার পরই আমার কথার স্টক শেষ হয়ে যায়। তখন আমি চুপ করে থাকি। কথা খুঁজে বেড়াই। ও প্রান্ত থেকে প্রায়ই বলে, লাইনে আছ! এজন্য অনেকে আমাকে ভুল বোঝে, খারিজ করে দেয়।
রিমনকে আমি কলব্যাক করলাম। রিমন বলল,
-কেমন আছেন জসিম ভাই!
-এই তো ভাল। তুমি কেমন ভাইজান! আমি মজা করি।
-আপনার সমস্যা কি জসিম ভাই!
-কেনো কি হইছে!
-আপনি ম্যাসেঞ্জার চেক করেন না!
-করি তো।
-আমি যে আপনাকে এতোবার ফোন করেছি, ম্যাসেজ দিয়েছি দেখেন নি!
জানি আমি পুরাই ধরা। একটু লাজুক হাসি। বলি, আমি একটু আইলসা স্বভাবের, মাইন্ড খাইও না।
-আপনাকে এ পর্যন্ত তেরো বার ফোন করেছি। এই বলে রিমন ডেট বলতে লাগল কবে কবে ফোন করেছে।
-আসলে হয়েছে কি দোস্ত,আমি রিমনের মন গলানোর চেষ্টা করি, আফটার অল রিমন একজন সংসদ সদস্য। তাও সরকারি দলের! তার ফোন ইগনোর করছি! সাহস তো কম না আমার!
-শোনো ভাইয়া তোমার যখন দিন আমার তখন রাত। সময়ের হেরফেরের জন্যই..।
-আমি জানি সেটা। আমি যখন ফোন করি হিসাব করেই করি। তখন আপনার ঘরে থাকার কথা। ফোনের রিপ্লাই দেওয়া ভদ্রতা!
আমি হেসে বলি, কথা সত্য। আবার কাজেও থাকিৃ।
-আপনার সাথে কতদিন পর কথা হলো জানেন!
-বেশিদিন না। কয়েক বছর আগেই কথা হয়েছে বরিশালে!
-তাও প্রায় দশ বছর। সব ভুলে গেছেন!
-ভুলব কেনো, কিছু ভুলিনি। মনে পড়ে, তোমার গেঞ্জি পড়ে কলেজে যেতাম!
রিমন হেসে বলল, হ্যাঁ অনেক স্মৃতি।
-তুমি কোথায় এখন!
-আমি ঢাকায়। ন্যাম ভবনে। এমপি হোস্টেল চেনেন!
-নাম শুনেছি।
-ঢাকায় আসেন একটা ফোন দেন না। আমি আপনার সব খবর রাখি।
আমি হেসে বললাম, সরি দোস্ত এরপর ঢাকা গেলে এয়ারপোর্টে নেমেই তোমার সাথে দেখা করব।
-কতগুলো বই বের হইছে আপনার এ পর্যন্ত!
-পঁয়ত্রিশটার মতো।
-ফেসবুকে দাদুকে(মা কে) নিয়ে আপনার একটা লেখা পড়ে বুকটা কেমন ছ্যাত্ করে উঠল তাই ফোন দিলাম।
করোনা কালের এই মহা দুর্যোগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার সব মন্ত্রী, এমপি, মেয়র, প্রিমিয়ার, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী কারো দম ফেলার সময় নাই। দিনরাত কাজ করছেন তারা। জনগনই শেষ কথা তাদের কাছে।জে
জেসমিন কালকে বলল, দেখেছো ট্রুডোর চেহারা কেমন হয়ে গেছে! এতো সুন্দর মানুষটা চেহারা মলিন লাগছে!
কথা সত্য। প্রতিদিন জাষ্টিন করোনা প্যানাডেমিক নিয়ে ব্রিফীং করেন। সাংবাদিকরা কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করেন, প্রধানমন্ত্রী শান্তভাবে, ঠান্ডা মাথায় প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেন।
বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা এই দুর্যোগে আন্ডাৱগ্ৰাউন্ডে না থেকে জনগনের পাশে থাকবেন বলে আশা করি। তাদের সাহস দেবেন, সহযোগিতা করবেন। গরীবের ত্রাণের চাল, তেল চুরি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। রিমনকে এই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলা হলো না..।
টরন্টো ২২ এপ্রিল ২০২০

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge