কানাডার টরন্টো থেকে
বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী
করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-২
টরন্টো আসার পর ছেলে মেয়ের কাছে যাওয়া হয়নি। ছুঁয়ে দেখা হয়নি। তারাও আসেনি কেউ। আসতে মানা। আমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকন্ঠায় ছিল অৰ্ক। প্রতিদিন ম্যাসেজ পাঠাত বাবা চলে আসো, যেভাবে পারো চলে আসো। সেই অৰ্কর সাথে আমার ভিডিওতে কথা হয়। অরিত্রি একদিন বাসার নিচে পৰ্যন্ত এসেছিল। সব পরিবারের জীবনে নেমে এসেছে এমন এক অবস্থা। সোশ্যাল ডিসটান্সিং। এটাই নিরাপদ পন্থা। সবারই এটা মানা উচিত। পৃথিবী এতোবড় সঙ্কটে পড়েনি আগে। তাই অভ্যস্ত হতে সময় লাগছে। সবার আৰ্থ সামাজিক অবস্থাও এক না। খেটে খাওয়া মানুষদের বেশিদিন আইসোলেশনে থাকা সম্ভব হবে না। আশাকরি ততদিনে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আশা নিয়ে বসে থাকি।
সময় যেনো অনড় পাথর। কোনো কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। বই পড়তে না, লিখতে না। এমনকি খবরও দেখি না। ওসব দেখে মন ভারাক্রান্ত করতে ইচ্ছা করে না। শুধু মুভি দেখি আর গান শুনি। ফোনেও কথা হয় না তেমন কারো সাথে। ফোনালাপে আমি ভাল না। বোরিং। আমার কথা আসে না তেমন। কিন্তু সবার জন্য ফীল করি। মনে মনে ভালবাসা দেই। শুধু প্রতিদিন সকালে এগারোটার দিকে জাস্টিন ট্রুডোর ব্রিফীং শুনি। যেনো ওটার জন্যই আমি অপেক্ষা করি।
এবার ঢাকা গিয়ে আমার ছেলে মেয়ের কিছু পুরনো ছবির এলবাম খুঁজে পেয়েছি। একসময় আমি ওদের অনেক ছবি তুলতাম। আমার একটা পেনটাক্স কে১০০০ ক্যামেরা ছিল। একটা না দুটো ছিল। সেইসব ছবি প্রিন্ট করতাম গুলশান এক এ ফুজি কালারের একটা ল্যাব ছিল সেখান থেকে। কাজটা যথেষ্ট ব্যায়বহুল ছিল তা সত্বেও কিভাবে তারা বেড়ে উঠছে সেইসব ধারাবাহিক ছবি তুলে এলবামে সাজাতাম আমি।
অৰ্ক অরিত্রিকে ফোন করি মাঝে মাঝে। দিনের বেলা ব্যস্ত থাকে অফিসের কাজে। অরিত্রি করোনা কাল আসার আগেও সপ্তাহে দু’তিন দিন ঘরে বসেই অফিস করত। এমনকি এবার যে ঢাকা গেলো এক সপ্তাহের জন্য সেখানেও রাত জেগে কাজ করেছে। টরন্টোতে যখন দিন ঢাকায় তখন রাত। আমাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিল বাবা, ওয়াইফাই যেনো থাকে। কালকে অরিত্রিকে ফোন দিলাম, তখন বেলা তিনটা…
আম্মু কি করো।
এইতো লাঞ্চ ব্রেক ছিল।
খেয়েছো!
হ্যাঁ।
কি খেলা আম্মু!
একটু ¤øান কন্ঠে বলল, পাস্তা খেয়েছি।
কালকেও জেসমিনের কাছে শুনেছি পাস্তা খেয়েছে। মনে মনে বলি, আজও!
মজা হয়েছে!
অরিত্রি হেসে বলল, হ্যাঁ।
তাও ভাল এই সুযোগে অরিত্রি রান্নাটা শিখে ফেলছে।
সাতটার দিকে অৰ্ককে ফোন দিলাম..
কি করো আব্বু।
এই তো বাবা, ডিনার করব, প্রিপারেশন চলছে।
খাতিজা কি করে।
ও চিকেন রান্না করছে। তারপর অৰ্ক বলল, আজকে মিষ্টি বানালাম বাবা, রসগোল্লা তোমাকে ছবি পাঠাচ্ছি।
ওহ গ্রেট। ঠিক আছে। সাবধান থাক। বাইরে যেওনা দরকার ছাড়া।
টরন্টো ১ এপ্রিল ২০২০
মুভি দেখতে দেখতে হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম কাল। মুভি চলছে, আমি টিভির দিকে তাকিয়ে আছি কিন্তু দেখছি না। কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করছি আনমনে। এমনকি মুভির নাম পর্যন্ত জানি না। টিভি অফ করে দিলাম। নিজের মনোযোগ অন্যদিকে ডাইভার্ট করার উপায় খুঁজছি। হাতের কাছেই ফোন। সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। কেনো যেনো ফোনটাকেও হঠাৎ একটা আপদ মনে হতে লাগল। নেগেটিভ বার্তা বহনকারী। ওয়াইফাই এবং ফোনের ডাটা দুটোই অফ করে দিলাম। এই যন্ত্রটাকে আমরা জীবনের অনিবার্য অংশ করে তুলেছি। যেনো এটা না থাকলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে। যখন সেল ফোন ছিল না তখনওতো জীবন চলেছে। আমি একসময় প্রচুর চিঠি লিখতাম। পত্রলেখক হিসাবে আমার একটা সুখ্যাতি ছিল। অনেক পেনফ্রেন্ড ছিল। সেইসব চিঠি ডাকবিভাগের মাধ্যমে আদান প্রদান হতো। আজকের দিনের মতো ম্যাসেঞ্জার, হোয়টসএপ বা অন্য মাধ্যমে দ্রæত লিখে, দ্রæত উত্তর পাওয়ার যে আনন্দ সেটা সম্ভব ছিল না কিন্তু অপেক্ষারও একটা আনন্দ ছিল।
পৃথিবীতে কিছুই অনিবার্য না। টিভিও না, ফোনও না, সংবাদপত্রও না। সবকিছু জানতে হবে, বুঝতে হবে, দেখতে হবে এমন কোনো কথা নাই। অনেক কিছু না জেনে না বুঝেও জীবন চলে যাবে। জীবনের প্রতিকুলতা আর দুঃসময়কে যত সহজভাবে গ্রহন করা যায় ততই ভাল। মৃত্যু নিয়ে এতো আদিখ্যেতারইবা কি আছে। অসুখে বিসুখে, মহামারিতে না হয় সাধারণ মুত্যু হবে। মৃত্যুকে কেউ রোধ করতে পারবে না। আগে অথবা পরে দরজায় এসে কড়া নাড়বে। তা নিয়ে এতো ভেবে কি হবে। মৃত্যু একটি মহান ঘুম এর বেশি কিছু না। নিজের মনোযোগ সারাক্ষণ একটি জায়গায় নিবিষ্ট হওয়ার কারণে একটা ভীতি, একটা প্রচন্ড মানসিক চাপ তৈরী হয়েছে। সেই চাপ থেকে মুক্ত থাকার জন্যই টিভি, খবরের কাগজ, ফোন, ট্যাবলেট এসব গ্যাজেটস থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চাচ্ছি। অন্য কিছুর প্রতি মনোযোগী হতে চাই। কোরান পাঠ তার মধ্যে অন্যতম হতে পারে। কিংবা প্রিয় বইগুলো পড়া যেতে পারে। কাল সারাদিন পড়েছি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস মায়াবতী এবং তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে। এই সব হালকা টাইপ উপন্যাস মনকে প্রফুল্ল রাখে।
লেখালেখিও করা যেতে পারে এই সুযোগে। সেজন্য লেখক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখুন। নিজের আনন্দ বেদনার স্মৃতিগুলো লিখে রাখুন। ভাল সময়ে সেইসব স্মৃতি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারবেন। যে বইগুলো এখনও অপঠিত রয়ে গেছে সেগুলো পড়ুন। অথবা পছন্দের বই বারবার পড়ুন। কবিতা আবৃতি করুন নতুবা গান শুনুন। সন্তানদের সাথে আরো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলন। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করুন, সাহস দিন। স্ত্রীকে ঘরের কাজে সাহায্য করুন। কৃচ্ছতা সাধন করুন। সামনে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সমূহ সম্ভবনা আছে। কোটি কোাটি মানুষ চাকুরি হারা হয়েছে। বিত্তবানরা গরীবের পাশে দাঁড়ান, তাদের সাধ্যমতো সাহয্য করুন। এখনই সময়।
যারা এই দুঃসময়ে জীবন বাজী রেখে মানুষের সেবা করছেন সেইসব ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, আর্মী, সরকারী কর্মকর্তা, সমাজসেবী, এনজিও, রাজনৈতিক কর্মী সহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি সহমর্মী হোন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। একসময় এই বিপর্যয় কেটে যাবে। সবকিছু আবার সুন্দর হবে। এক সুন্দর পৃথিবীর অপেক্ষায় মানুষ। যদি বেঁচে থাকি তাহলে এবার ফিরে আসব নিজের শিঁকড়ের কাছে। নিজের জন্মস্থানেই যেনো হয় আমার কবর। নিজের মা বাবার পাশে। আজ সারাদিন এই কথাগুলোই ভেবেছি। কেনো ভেবেছি তা জানি না। বরিশালের ছায়াঘেরা, শ্যামল সুন্দর, ঘুঘু আর ঝিঁঝি ডাকা শব্দের মধ্যেই যেনো হয় আমার মরন। আমি আর কিছুই চাই না, খ্যাতি চাই না, সম্পদ চাই না, নাগরিক উপভোগ চাই না, আমি শুধু ফিরতে চাই। এবার ফেরাও মোরে..।
টরন্টো ২ এপ্রিল ২০২০
আমি আশাবাদী মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। প্রতিদিনই এই স্বপ্নের কথা লিখি। নেগেটিভ খবরগুলো মনকে বিষন্ন করে তোলে তাই এড়িয়ে যাই। ভাল খবরগুলো খুব মন দিয়ে পড়ি। আনন্দ নিয়ে পড়ি। যে যা বলে তাই মন দিয়ে পড়ি। কিন্তু এড়িয়ে গেলেও অস্বীকার করতে পারি না। বুকের মধ্যে স্বপ বেঁচে আছে বলেই জীবনটাকে আনন্দময় মনে হয়। স্বপ্ন দেখি সবকিছু সুন্দর হয়ে যাবে। আগের জীবনে ফিরে যাব। ঘুম ভেঙে হঠাৎ ভুলে যাই যে আইসোলেশনে আছি। ঘরের বার হতে পারব না। দুজন মানুষ দুই ঘরে থাকি। সকালে এক টেবিলে বসে চা খাই না। সবসময় চা আমি বানাই, এখনও বানাই কিন্তু একা একা খাই।
বাইরের দিকে তাকাই কোথাও কোনো জনমানুষ্যি চোখে পড়ে না। খুউব ভোরে একজজন নিঃসঙ্গ মানুষ শুধু রাস্তা ক্লিন কওে প্রতিদিন। ময়লাও হচ্ছেনা তেমন রাস্তাঘাট। মানুষের জন্যইতো সব। সেই মানুষ নাই কোথাও। শিশুরা খেলতে নামছে না, স্কুল বন্ধ। শিশুদের কোলাহল নাই। নিরব নিথর। হুইল কার এসে থামছে না আর। দূরে কখনো একটা দুটা গাড়ি যায় হুস করে। এক অচেনা পৃথিবী। যেনো অন্য এক গ্রহে ঢুকে পড়েছি। একজন দু’জনের হাতে বাজারের থলে, কেউ কারো দিকে তাকায় না। এলিয়েন পৃথিবী। অচেনা সব, অচেনা আত্মীয়, বন্ধ,ু সন্তান। সবাই সবার কাছ থেকে দূরে। জড়াজড়ি, গাড়গড়ির দিনগুলো থমকে গেছে।
মাঝে মাঝে জেসমিনকে লক্ষ্য করি। কিচেনে কাজ করছে। আমি দূরত্ব বজায় রেখে টিভি দেখছি। দূর থেকে কথা বলি। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনিনা অনেকদিন। মনে মনে বলি এই মানুষটাকে কি চিনি! কতবছরের চেনা মানুষটি। ৩১ বছর একসাথে আছি। কাছেই আছি কিন্তু কত দূরে। ফিসিক্যিাল ডিসট্যান্স। সোশ্যাল ডিসট্যান্স, কোয়ারেনটাইন, আইসোলেশন কত টার্ম শিখেছে পৃথিবীর মানুষ। এর মধ্যেও যারা মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারাই মহান মানুষ। শ্রেষ্ঠ মানুষ। এই ছবিটিতেই দেখুন আমেরিকার অন্যান্য ষ্টেট থেকে ডাক্তার, নার্সরা আসছেন নিউইয়র্কে সেবা দিতে, কত আনন্দ নিয়ে আসছেন। এই দুর্যোগে ডাক্তার নার্সরাই ভরসা। বাংলাদেশের অনেক ডাক্তার নাকি ভয়ে পালিয়েছেন। এটা ঠিক কাজ না। আমি প্রতিটি লেখায় তাদের কথা বলেছি। ঘরে থাকুন, কানেক্ট থাকুন।
টরন্টো ৩ এপ্রিল ২০২০
এই প্রথম পৃথিবীর সব মানুষ একযোগে অভিন্ন এক ভয়ে আক্রান্ত। সেটা হচ্ছে মৃত্যু। ক্রমেই ধেয়ে আসছে! অনেকেই প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন। মৃত্যু কিছু নতুন ঘটনা নয়। সবারই এর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই সবাই সবার মনের অবস্থা জানি। যার সাথেই কথা হয় সেই বলে আর কি দেখা হবে! কবে এর শেষ হবে! চরম নাস্তিকরাও বুঝেছে যে এমন একটা পরাশক্তি আছে যার উপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা কারো নাই। সবাই এখন তার করুণা প্রাথনা করছে। তার শক্তির কাছে নতজানু হয়েছে। ক’দিন আগেও যারা এসব নিয়ে বাহাদূরি করেছে, নানা যুক্তি দিয়েছে আছে কি নেই তারা এখন চুপসে গেছে। এটা একটা পরীক্ষা। মানবজাতিকে এটা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পৃথিবীতে চেক এন্ড ব্যালেন্স নেই বলেই এমনটা ঘটেছে। সবকিছুই আবার সুন্দর হবে কিন্তু তখন আমরা অনেকেই থাকব না। তবুও ভাল থাক, ঘরে থাক।
টরন্টো ৪ এপ্রিল ২০২০
আজ সকালটা খুব সুন্দর। নৈশব্দে ভরা চারদিক। দূরে মাঝে মাঝে দু’একটা বাস চলাচল করতে দেখা যায়। কিছু গাড়িও চলছে। প্রয়োজনে মানুষকে বাইরে বের হতে হচ্ছে। তেমনি দু’একজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছি। ভিজিটর পাৰ্কংি এ আজকে কয়েকটা গাড়ি আছে। রাতে হয়ত ছিল এরা নিকাত্মীয়র কাছে। অন্য সময় পাৰ্কংিএর জন্য পে করতে হয় কিন্তু এখন ফ্রী। এই দৃশ্যই ছিল স্বাভাবিক কিন্তু সবকিছু বদলে গেছে। তাও আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। এটা আমার অবচেতন মনের অনুভূতি।
টরন্টো ফিরে আসার পর থেকে এমনটা দেখিনি। আজকে সকালটাও রৌদ্রকরোজ্জল। চকচক করছে চারিদিক, ঝকঝকে নীলাকাশ। মৃদু বাতাস বইছে। গাছপালাগুলো এখনো পত্র পল্লবহীন। ঠান্ডার প্রকোপও কমে গেছে। আজ ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। চাইলে একটু হাঁটাহাঁটিও করা যায় বাইরে। একটু দূরেই ডনভ্যালি পাৰ্কওয়ে। ওটা হাইওয়ে। সবসময় বিজি থাকে। ঘরে বসে কান পাতলে গুমগুম গাড়ি চলার শব্দ পাই একটানা। এখন পাচ্ছি না। ডিভিপিতে ব্যস্ততা নাই তেমন।
আমার সেলফ আইসোলেশনের দ্বাদশ দিন আজ। ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ঘর যেনো। আর দু’দিন পর একটি ঘর থেকে মুক্তি পাব। অটোয়াতে শরিয়ত উল্লাহ নামে একজন বাঙালি মারা গেছেন গতকাল। করোনায় প্রথম বাঙালি মারা গেলেন। টরন্টোতেও আমাদের সবার প্রিয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাম শরীফ এবং তুতিউর রহমান নামে একজন হাসপাতালে আইসিউতে আছেন। তাই মনটা আপসেট হয়ে আছে। আজকে পৰ্যন্ত কানাডায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃতের সংখ্যা প্রায় ২৫৪।
কালকে জেসমিন বলছিল একটা জিনিস খেয়াল করেছো!
আমি বললাম কি!
দেখেছো কবুতরগুলো কেমন আনন্দ করছে!
সেটাা কেমন!
আগে কবুতরগুলো দল বেধে চলাচল করত। এখন তারা মনের সুখে যে যার মতো একা একাই উড়ছে, ঘুরছে, খেলছে, ডীগবাজি খাচ্ছে। কোনো ভীতি নাই, শঙ্কা নাই।
আজ ঘুম ভেঙে ব্যাপারটা খেয়াল করলাম এবং ঘটনা সত্যি। আমাদের এলাকায় শত শত কবুতর। অনেক যন্ত্রণা করে কবুতরগুলো। নোংরা করে বারান্দা কিন্তু কিছু করারও নাই। কিছু বলা যাবে না। দন্ডনীয় অপরাধ। আমি বারান্দার চারিদিকে নেট দিয়ে আটকে দিয়েছি। মনে হয় আমার উপর ক্ষুব্দ কবুতরগুলো। এখন তারা মনের আনন্দে বেড়াচ্ছে। এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি যাচ্ছে, খাচ্ছে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো। যেনো ভয়ভীতিহীন এক নতুন পৃথিবীতে তাদের আগমন ঘটেছে!
টরন্টো ৫ এপ্রিল ২০২০
প্রতিটা দিন এক একটা সুন্দর দিন। স্বর্নালী আভায় ছড়ানো এক একটা দিন। ঘুম ভেঙে আবার একটা নতুন দিন দেখতে পাচ্ছি, পাখীদের ডাক শুনতে পাচ্ছি, মুদু সমিরনের দোলা লাগছে হৃদয় মনে তাওতো কম না। বেঁচে যে আছি এটাই বিরাট ঘটনা! প্রতিদিন রাতে জেসমিনের আগে আমি বেডে যাই। এখন আইসোলেশনে আছি বলে আমি আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ থিউরিতে চলছি। জেসমিন বসে বসে সিপি২৪ দেখে। নিউজ চ্যানেল। জেসমিনের কাজই হচ্ছে সকাল বিকাল আপডেট শোনা। জাষ্টিন ট্রুডোর ব্রিফীং শোনা। কাল রাতে তখন দশটার মতো হবে, হঠাৎ সাইরেনের শব্দ। প্যারামেডিক, ফায়ারব্রিগেড এবং পুলিশ একযোগে যাচ্ছে।
জেসমিন বলল শুনেছো!
হ্যাঁ। তো কি। এরকম তো হতেই পারে। নর্মাল সময়ওকি হয় না! মানুষের অসুখ বিসুখতো থেমে থাকবে না। এটাও তেমনি।
তাই যেনো হয়।
আমি কথা বাড়াতে দেই না। নেগেটিভ কিছু নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছা করে না। জেসমিনকে শুধু বলি সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। দেখোনা ইউরোপ আমেরিকায় কমে আসতেছে। নিউইয়র্কের জন্য চিন্তা হয়। সেখানের খবরও ভাল।
জেসমিন বলল, আল্লাহ বাংলাদশেকে রক্ষা করো। বাংলাদেশের উপর আল্লাহর রহমত আছে। দেখবা কিছু হবে না।
কিন্তু মানুষ কথা শোনেনা। ঘরে থাকতে বলেছে কিন্তু ঘরে থাকছে না। এদিকে বিজিএমইর সভাপতি রুবানা হক লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন। অনেকে ঘরেই ফিরতে পারেনি এখনও। এখন তাদের কি হবে!
ওনার সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা শুনতাম। খুব আদর্শের কথা বলতেন।
আরে ধুর। ধনীক শ্রেনীর আদর্শ হচ্ছে মুখে মুখে। সব ভন্ড। লুটেরা।
আমি তখন গভীর ঘুমে। হঠাৎ গগনবিদারী সাইরেনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। রাত দেড়টা। আমাদের বিল্ডিংএ ফায়ার এলার্ম বেজে উঠল। মনটা খারাপ হয়ে গেলো কেনো যেনো। এমন যে আগে হয়নি তাতো না! নিয়ম হচ্ছে এলার্ম বাজার ১২ মিনিটের মধ্যে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি চলে আসবে। আমি চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। এলার্ম বেজেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এই এলার্ম বাজবে। এখনও স্পীকারে কেউ কিছু বলছে না! আজ কি কেউ আসবে না! এখনতো নর্মাল সময় না হঠাৎ মনে হয় আমার। প্যারামেডকি, পুলিশ সবাই ব্যস্ত। না। সময়মতোই চলে এসেছে। একটু পর এলার্ম থেমে গেলো।
আমি বিছানা থেকে উঠে দেখি জেসমিন ঘুমানো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। লাল আলো জ্বলছে নিভছে গারির মাথায়। কাজ শেষ করে পুলিশ চলে যাচ্ছে। একজন সাদা মানুষ মাথায় হেলমেট পড়ে গাড়িকে ব্যাক করার নির্দেশ দিচ্ছে। মানুষটাকে আমার ঈশ্বরের মতো মনে হলো। তার মুখে মাস্ক বা হাতে কোনো গøাভস নাই। সে এসেছে জীবন বাঁচাতে। নিজের জীবনের পরোয়া করছে না।
হুমায়ূন আহমেদ তার এক উপন্যাসে লিখেছেন, কার্যকারণ ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। কথাটা সত্য। নিশ্চয়ই আজকে এই পৃথিবীজুড়ে মাহামারির পিছনে কোনো কার্যকারণ আছে। হয়ত পৃথিবীর মঙ্গল অপেক্ষা করছে সামনে। এজন্য কিছুেেতা মূল্য দিতেই হবে মানবজাতিকে। সেই মূল্য দেওয়া শুরু হয়েছে।
মহাখালিতে কড়াইল বস্তি সবাই চেনেন। বিশাল বস্তি। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় এখানে। ড্রাগের কারখানা। ওপেন। সবাই জানে। সবাই ভাগ পায়। পুলিশ থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত। এই কড়াইল বস্তিতে থাকে ক্যানার মা। ক্যানার মা এক সময় আমার শুশুরবাড়িতে কাজ করত। পুরো মহাখালি জুড়ে আমার শশুড়কুলের রাজত্ব। ক্যানার বয়স যখন ২৪ তখনই তার তিনটা বউ এবং ৯টা ছেলে মেয়ে। এরা সবাই করাইলের বাসীন্দা।
এবার কার্যকারনের কথা বলি। সেটা হচ্ছে এই, যদি আমরা সোশ্যাল বা ফিসিকাল ডিসট্যান্স মানি তাহলে বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। ওভার পপুলেটেড যেমন চায়না, ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য মঙ্গলই হবে। আবার ইউরোপ আমেরিকার জন্য একটু সমস্যা হবে। জনসংখ্যা সমস্যা। উন্নত দেশগুলি তৃতীয় বিশ্ব থেকে শ্রমিক বা ইমিগ্রান্ট আনার ব্যাপারে চিন্তা করবে। হয়ত কয়েক বছর বন্ধ থাকবে। কানাডার মতো দেশে এমনতেই গত ৩৫ বছর ধরে তাদের প্রয়োজনের চেয়ে জনসংখ্যার ঘাটতি। এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলেই অনুমান করি।
যেহেতু করোনার এখনও কোনো প্রতিশেধক বাজরে আসেনি অতএব সোশ্যাল ডিসটেন্সই একমাত্র প্রতিশেধক এই মুহূতে। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মৃতের সংখ্যাও। অতএব সাবধান! ঘরে থাকুন।
টরন্টো ৬ এপ্রিল ২০২০
করোনা উত্তর পৃথিবী কেমন হবে তা দেখার সুযোগ পাব কিনা জানা নাই। মহামারির পর মহামন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অথনীতি ধ্বসে পড়ছে, চাকরি হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ ইতিমধ্যে। পৃথিবীর জায়ান্ট অথনীতির দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। কাযত ২০২০ সাল পুরোটাই হবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বছর। সব বড় বড় ইভেন্ট বাতিল হয়ে গেছে। স্কুল, কলেজ, অধিকাংশ ব্যাবসা, অফিস শাটডাউন। উড়োজাহাজ উড়ছে না। সমুদ্র শান্ত। গাড়ির ধোঁয়ার পলুশন নাই, গ্যাসের দাম পড়ে গেছে। মানুষ গৃহবন্দী। এই বন্দীত্ব কবে ঘুচবে জানা নাই। আমার ১৪ দিনের করোনটাই শেষ। একটু স্বস্তি পেলেও জীবন স্থবির হয়ে আছে। কবে এই স্থবিরতা ঘুচে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাব জানি না। আবার কাবে নিভয়ে বাইরে যাব, আড্ডা দেবো, ঘুরে বেড়াব পৃথিবীর নানা প্রান্ত কে জানে। তবে এটাও ঠিক পৃথিবী আর আগের অবস্থায় ফিরবে না। অনেক কিছু বদলে যাবে, নিয়ম বদলাবে, অভ্যাস বদলাবে, দূরত্ব রচিত হবে, অবারিত যাতায়াত রহিত হবে। এক নতুন পৃথিবীর দ্বারপ্রান্তে মানুষ হয়তবা।
টরন্টো ৭ এপ্রিল ২০২০