বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৩৭ পূর্বাহ্ন

করোনাকাল এবং সিনেমার গল্প…-জসিম মল্লিক

করোনাকাল এবং সিনেমার গল্প…-জসিম মল্লিক

করোনাকাল এবং সিনেমার গল্প..
জসিম মল্লিক


১৯৭৩ সালে ’রংবাজ’ সিনেমা দেখে আমি প্রথম একশন মুভির প্রেমে পরি। তখন আমার বয়স কতই আর। বারো হবে। সেই থেকে সিনেমা মানেই একশন।
রংবাজ সিনেমার প্রথম দৃশ্যটা ছিল এমন, নায়ক রাজ্জাক জসিমকে বলে, কিরে জসিম তুই নাকি আজকাল মাস্তানি করছস।
জসিম বলে, করছি তো কি হইছে।
রাজ্জাক এরপর জসিমের পিঠে টোকা দিয়ে বলে এই জসিম,
জসিম ঘুরে তাকাতেই মুখে প্রবল ঘুসি। তারপর হেভি ফাইট। এখনও টিভির রিমোট হাতে নিয়ে ছবির জেনেরি একশন কিনা দেখি আমি। নিদেনপক্ষে থ্রিলার হলেও চলে। হলিউড মুভি আমার প্রথম পছন্দ, তারপর হিন্দী। আজকাল ঢাকার মুভিতেও ভাল একশন করে। স্পেশাল ইফেক্টগুলো ভাল হয়। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঢাকাইয়া একশন মুভি দেখলাম।
রিটন ভাইকে সেদিন বললাম, ঘরবন্দী জীবনে প্রচুর মুভি দেখছি।একশন মুভি।
রিটন ভাই বললেন, একশন মুভি আপনার কেনো পছন্দ জানেন!
কেনো বলেনতো!
মিয়া আপনে অন্যায় দেখলে ভিতরে ভিতরে গজরাতে থাকেন কিন্তু কিছু করতে পারেন না। নিরীহ টাইপ। তাই নায়ক যখন ভিলেনকে পিটায় আপনে ভাবেন আপনে নিজেই পিটাইতেছেন।
আমি হে হে হে করে বললাম, কথা সঠিক।

আবার এটাও ঠিক একশন ছবিতে ঠু মাচ ভায়োলেন্স আমার পছন্দ না। আমি পছন্দ করি সফট ভায়োলেন্স, যেমন ভিলেন ঘুষি খেয়ে স্লো মোশনে উড়ে গিয়ে ঝুর ঝুর করে কাঁচ সহ ভেঙ্গে পড়বে, নায়ক ঘুষি খেয়ে পড়ে গিয়েও ব্যাঙের মতো জাম্প করে উঠে দাঁড়াবে এই রকম দৃশ্য। গান ফাইট পছন্দ আমার। শিহহহহ শব্দ তুলে রিভলভারের গুলি থ্রি ডাইমেনশনে চোখের সামনে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে এফোর ওফোর করে দেবে দুষ্ট লোকের বুক। ছুড়ি, চাকু, তলোয়ার, বর্শা, তীর, ধনুক আমার পছন্দ না। এজন্য ঐতিহাসিক ছবি আমি দেখিনা। হরর বা সাইন্স ফিকশনও না পছন্দ। যখনই ভায়োলেন্স টাইপ কোনো দৃশ্য সামনে আসে, যেমন ঝক ঝকে ধারালো নাইফ দিয়ে কন্ঠনালী ঘ্যাচাং করে পোচ দিয়ে কেটে ফেলবে বা কথা আদায় করতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলবে মনে হলেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। অপরাধীকে যখন আচ্ছামতো পেটায় তখন আমার ধমনীতে রক্তের নির্যাস ছোটা ছুটি করে। মনটা তৃপ্ত হয়।

করোনা নিয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখতাম। এখন লিখি না। লিখতে ইচ্ছে করে না। লেখার মন নাই। মন বিষন্ন। তাই এখন স্মৃতিকথা, ফিলোসফিক প্রেম, ছেলে মেয়ে এসব এলেবেলে টাইপ লেখা লিখি। অনেকটা একশন ছবির ভায়োলেন্স থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর মতো। করোনা ভুলে থাকার চেষ্টা। ব্ইমেলার জন্য উপন্যাস লেখার কথা ছিল। বইমেলা হবে কিনা কে জানে! পৃথিবীতে কোথাও কোনো ভাল খবর নাই। প্রতিদিন মুত্যুর খবর। রাতে ঘুমাতে পারি না। মন শরীরের উপর প্রভাব ফেলে প্রবলভাবে।
এর আগেও পৃথিবীতে অনেক প্লেগ এসেছে, অনেক মানুষ মরেছে, আবার একদিন ঠিক হয়ে গেছে। বন্ধু কবি মোয়াজ্জেম খান মনসুরের একটা লেখা থেকে জানলাম ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকান সৈন্যরা এক ভয়ংকর মরণ ব্যাধি নিয়ে এসেছিল। হংকং ফ্লু নামে এই রোগে এক লাখ আমেরিকান এবং চার হাজার কানাডিয়ান মারা গিয়েছিল। ইউরোপেও হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। তখন এতো প্রচার ছিল না।
খ্যাতিমান সাংবাদিক নঈম নিজামের একটি সচিত্র পোষ্টে দেখলাম ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর সময় থেকেই মানুষ মুখে মাস্ক, হাতে গ্লভস পড়ত(ছবি দ্রষ্টব্য) এবং দশ জনের বেশি একত্রিত হতে পারত না। একশ বছর পরও নিয়ম কানুন তেমন পাল্টায়নি। সে সময় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। এখন হাইটেকের যুগ বলেই এতো আপডেট জানতে পারছি আমরা এবং হতাশাও বাড়ছে।

দুর্যোগ আর হতাশা কেটে যাবে একদিন। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন। সুন্দর ভোর হবে। ইতিমধ্যে আমরা অনেক আপনজন হারিয়েছি। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। কার কখন ডাক আসবে জানা নেই। আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সেটা হচ্ছে আমরা কি একটুও বদলেছি! আমরা কি আমাদের ভিতরের পশুটাকে একটুও দমন করতে পেরেছি! সত্যবাদী হতে পেরেছি! নিজেকে নিজে এই প্রশ্ন করার দরকার আছে। যাউকগা কঠিন কথা বাদ দিয়ে একটা হালকা গল্প দিয়ে লেখা শেষ করছি।
রংবাজ ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম আমার বড় আপার সাথে। বরিশাল বিউটি সিনেমা হলে। ছবিতে বৃষ্টির মধ্যে একটা গান আছে।.. হোই হোই রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে, রিম ঝিম ঝিম বরষায় মন নিলা রে..। গানের শেষে রাজ্জাক-কবরী একটা ঝোঁপের আড়ালে চলে যায় এবং শুধু দেখা যায় একজনের পা আর একজনের পায়ের উপরে নড়াচরা করতেছে…। বড় আপা সেদিন বাড়িতে গিয়ে আমাকে আচ্ছা মতো বকেছিল, এই বয়সে তোর এতো সিনেমা দেখার কি হইছে!
টরন্টো ২৯ মে ২০২০

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge