সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:০৮ অপরাহ্ন

কণাবাদী মহাবিশ্ব থেকে বহুমহাবিশ্ব ভাবনা-জাহিদ হোসেন

কণাবাদী মহাবিশ্ব থেকে বহুমহাবিশ্ব ভাবনা-জাহিদ হোসেন

অনেকদিন ধরে মহাবিশ্বের কণাবাদী ব্যাখ্যা নিয়ে একটি সহজবোধ্য প্রবন্ধ লিখবো ভাবছি। এ বিষয় প্রবন্ধগুলো ইংলিশে বেশি হয়। বঙ্গানুবাদগুলো প্রায় সবই বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের নির্দেশ-গ্রন্থ হিসাবে লেখা। কারণটা খুবই যৌক্তিক। এদেশে মহাবিশ্ব সংক্রান্ত সাধারণ ধারণা একদম সেকেলে। তাই বিজ্ঞান লেখকগণ কাটতির জন্য পাঠকদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতি রেখে এবং শুধু নিউটনিয় চিরায়ত বলবিদ্যা নিয়ে বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনা করেন। যার অধিকাংশই পৌরাণিক ধ্যান-ধারণা সম্বলিত। জগতের কণাবাদী চিন্তা তো বহুত দূর কি বাত। প্রসঙ্গত প্রশ্ন আসে যে, ধুলোময়লাতত্ত্ব জেনে কী লাভ? উত্তর হলো : জগতের কাঠামো বস্তুত অতিক্ষুদ্র ধুলোকণা দিয়ে গঠিত। আমাদের ভৌতদুনিয়া অসংখ্য বস্তুরাজির মেলা। এর প্রতিটি ভেঙে অসীম সংখ্যক টুকরো করা যায়। তবে একটা বস্তু ভাঙতে থাকলে নিশ্চয়ই এর সবশেষ ক্ষুদ্র একক মিলবে। তাইলে উক্ত বস্তুর সবশেষ টুকরোটা কতো ক্ষুদ্র? জগতের সব বস্তুই কি এমন? সর্বশেষ টুকরোগুলোর সবই কি একরকম, না ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির? আবার এর বিপরীত প্রশ্ন—সবচে’ বড় বস্তু কতো বড়—যে কারও মনে জাগা স্বাভাবিক। এসব বহুশতাব্দী পুরাতন প্রশ্ন। কিন্তু এমন প্রতিটি প্রশ্নের শতভাগ নিশ্চিত উত্তর আজও মেলেনি। বস্তুত দৃশ্যমান জগত বিভিন্ন আকারের বস্তুর সমষ্টি। এই নানানাকৃতির বস্তুর মধ্যে মানুষও আছে। তাইলে মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্তুটির আকার একজন মানুষের চেয়ে কতো বড় হতে পারে? উল্টোভাবে সর্বশেষ ক্ষুদ্র কণার চেয়ে মানুষ কতো বড়—এইসব প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর মানুষের মন বিনত করে, হামবড়ামি কমায়। বিশ্বাসের আবেগে নয়, স্বীয় ক্ষুদ্রতা যৌক্তিকভাবে অনুধাবন করার শিক্ষা দেয়। পরার্থবাদী ও সমবণ্টনভিত্তিক পৃথিবী গড়ে তুলতে কেবল নমনশীল প্রকৃতির মানবজাতি প্রয়োজন। নইলে পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধ পৃথিবীকে কুড়ে কুড়ে খায়—বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যেমন চলছে। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য আসলে মানুষের মধ্যে নমনশীলতা ও পরার্থবাদী চেতনা জাগ্রত করা। স্টিফেন হকিং রচিত কয়েকটি বই, নেচার জার্নাল, কোয়ান্টা ম্যাগাজিন প্রভৃতি এই প্রবন্ধের সূত্র।

ইন্দিয়গ্রাহ্য জগতে কণা:
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুরাজি ভৌতজগত নামে পরিচিত। প্রাণীদেহের ১০-টি অঙ্গ; যথা : চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, বাক, হস্ত, পদ, পায়ু, উপস্থ (Skin) হলো Sensory System বা ইন্দ্রিয়। আবার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যজগত বোধ্য হয় প্রাণীর কিছু অদৃশ্য শক্তি দ্বারা—মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত, হিসাব, সিদ্ধান্ত, যুক্তি প্রভৃতি এর অন্তর্গত—এগুলো মূলত বোধশক্তি। মানুষের বোধশক্তি অতুলনীয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যমান বস্তুরাজির সাথে অতিক্ষুদ্র ধুলোবালুর অস্তিত্ব প্রমাণ করে, এজগতের সমস্ত বস্তুই ভেঙে অগণিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টুকরো করা যায়। এই সাধারণ ঘটনা ভৌতজগতের প্রকৃত গঠনের ধারণা দেয়। অর্থাৎ এজগত কিছু মৌলিক বস্তুকণার সমন্বয়ে গঠিত—ব্যাপারটি বহুশতাব্দী আগেই মানুষের তুলনাহীন বোধশক্তিতে ধরা দিয়েছে। অতঃপর গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে যে, কণার আছে ভর ও বল। উভয় ভর ও বল মহাবিশ্ব দৃশ্যমান করেছে। এর প্রকৃতি সম্মন্ধে ধারণা সুস্পষ্ট করতেই মানুষ বিজ্ঞানে এতো সফলতা লাভ করেছে। কিন্তু মৌলিক কণাদের চরিত্রে রয়েছে অসীম সম্ভাবনা, স্পিন ও বিজড়ন। এর মাঝে বিজ্ঞানীরা বহুমহাবিশ্ব (Multiverse) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব (Parallel Universe) সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন।

মহাবিশ্বের বাস্তবতায় এ যাবত বিজ্ঞান কতোটুকু এগিয়েছে?
মহাবিশ্বের বাস্তবতা মূলত বহুমুখী অথবা বিশেষ ও ব্যাপক উভয়ক্রমেই আপেক্ষিক। এই বাস্তবতার মূলে রয়েছে সম্ভাবনাময় মৌলিক কণাদের নিরন্তর চড়াই-উৎরাই। এসবের ব্যাখ্যায় গিয়েই যুগ যুগ ধরে নতুন বৈজ্ঞানিক প্যারাডাইম গঠিত হয়েছে। যদিও চিরদিন প্রতিযুগের প্যারাডাইম বৈজ্ঞানিক সেরা অর্জন বলে অভিভাবন (suggestion) করা হয়েছে। যেভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মহাবিশ্বের সমুদয় বিজ্ঞান জানা হয়ে গেছে বলে ভাবা হতো! উল্লেখ্য ম্যাক্স প্লাংক ১৮৭৪ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলে, বিভাগীয় অধ্যাপক ফিলিপ ভন জলি তাঁকে বলেন, “পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সবকিছুই আবিষ্কার হয়ে গেছে। কেবল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু ভুল শুধরাতে হবে।“ অতঃপর প্লাংককে তিনি ভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন! যদিও সে আমলে নিউটনিয় চিরায়ত বলবদ্যাতত্ত্ব অতিপারমাণবিক স্তরের ব্যাখ্যার পক্ষে যথেষ্ট ছিলো না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রয়োজন হয়। ল্যাবে অতিপারমাণবিক দ্বি-চিড় পরীক্ষায় বৈজ্ঞানিকগণ কার্বন আণুদের অনিশ্চিত অবস্থা দেখে চোখে শর্ষেফুল দেখেন। তাই আইনেস্টাইনসহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী কণাবাদের ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। যদিও নেইলস বোর, শ্রোডিংগার, হাইজেনবার্গ, পল ডিরাক, পাওলি, শোয়ারজশিল্ড, সত্যেন বোসু, চন্দ্রশেখর এবং আরও অনেক বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাংকের কোয়ান্টা তত্ত্ব এগিয়ে নিয়ে যান। তদুপরি আইনেস্টাইনের ভূমিকা এক্ষেত্রে মোটেই কম ছিলো না। আলোক তড়িৎ ক্রিয়া (Photo-Electric effect) তত্ত্ব অবিষ্কারের জন্য ১৯২১-সালে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এটা কোয়ান্টা তত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং ম্যাক্স প্লাংক :
ম্যাক্স প্লাংক (১৮৫৮ – ১৯৪৭) কণাবাদী বলবিদ্যার জনক। অতিপরমাণু জগতে নিউটনিয় চিরায়ত বলবিদ্যা কাজ করে না। বিষয়টি তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিলো। তাপগতিবিদ্যায় প্লাংকের বিশেষ আগ্রহ ছিলো। তাঁর আমলে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের একটি বড় সমস্যা ছিল কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ। কৃষ্ণবস্তু হলো এমন বস্তু, যার ওপর আপতিত সকল তড়িৎচুম্বক বিকিরণ শোষণ করে নেয়। বিজ্ঞানীরা ভাবতেন কৃষ্ণবস্তু উত্তপ্ত করলে তা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ বিকিরণ করে। এগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অতিবেগুনী, অবলোহিত ও দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যসীমায় পড়ে। কিন্তু ১৯ শতকে বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় ধরা পড়ে, উষ্ণবস্তুর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে চিরায়ত তাপগতিবিদ্যার কোনও মিল নেই। তত্ত্বের সাথে পর্যবেক্ষণের এই সমস্যা দূর করতে প্ল্যাংক একটি প্রস্তাব পেশ করেন : শক্তি অবিচ্ছিন্নভাবে এলোপাথাড়ি পরিমাণে নির্গত হয় না বরং নির্দিষ্ট পরিমাণে নির্গত হয়। এর নাম তিনি কোয়ান্টা দেন। এত্থেকেই মূলত কোয়ান্টাম তত্ত্বের উদ্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা এর দ্বারা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হন। প্লাংক দেখান যে, তড়িৎচুম্বক বিকিরণের সাথে বাহিত শক্তির পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হতে হবে। সংখ্যাটি প্ল্যাংকের ধ্রুবক (E=hv) নামে পরিচিত। এই সমীকরণ অনুযায়ী বিকিরণ থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণ হিসাব করা যায়। E=hv : E= শক্তির পরিমাণ, প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক h= ৬.৬২৬*১০-৩৪, v কম্পাঙ্কের সংকেত।

সবযুগের বিজ্ঞানীরাই কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করেছেন :
মহাবিশ্বের প্রাথমিক বা মৌলিক কণার (Elementary Particle of the universe) সর্বশেষ অবস্থার রূপায়ণ প্রস্তুত এবং এর বৈশিষ্ট নির্ধারণ করাই পদার্থবিজ্ঞানের মূল কাজ। সবযুগের বিজ্ঞানীরাই কমবেশি এই কাজে সময় ব্যয় করেছেন—সর্বপ্রথম গ্রিক আয়োনিয় দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (খ্রিপূ: ৪৬০-৩৭০) Atom-এর ধারণা দেন। যদিও যথাযথ উপাত্তের অভাবে তখন কোয়ান্টাম জগতের উপলব্ধি হয়নি। মধ্যযুগে নিউটন আলোকে কণাধর্মী বলেছেন। যদিও ইংলিশ বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং আলোকে তরঙ্গধর্মী আবিষ্কার করেন। তখন অনেকে নিউটনকে ভুল বলেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় আলো তরঙ্গ ও কণা উভয় আচরণ করে। আমরা এখন এই কণিকার নাম ভর ও আধানশূন্য ফোটন বলে জানি। আর সামসময়িক যুগের বিজ্ঞান গবেষণা মানেই কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা কণাবাদী পদার্থবিজ্ঞান।

বিজ্ঞানের বিকল্প ইতিহাস হলো কণাবাদী বলবিদ্যা :
বস্তুত পদার্থ গঠন হয় প্রাথমিক কণাদের সমন্বয়ে। তবে কণারা তরঙ্গধর্মী আচরণ করে। অস্ট্রিয়ার একদল বিজ্ঞানী ১৯৯৯-সালে ষাটটি কার্বন অণু দ্বারা গঠিত গোলাকার বাকি বলের দ্বি-চিড় পরিক্ষায় তা প্রমাণ করেন। ১৮০১-সালে ইংলিশ পদার্থবিদ থমাস ইয়ং প্রথম দ্বি-চিড় পরীক্ষা দ্বারা আলোকে তরঙ্গধর্মী বলেছিলেন। আলো এক ধরনের শক্তি অথবা তীর্যক তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ। পরমাণুর অভ্যন্তরীণ নিম্ন কক্ষপথে ইলেকট্রন লাফ দিলে এর বলবাহী ফোটন কণা ছুটে যায়। আমাদের মহাবিশ্বে ৪-প্রকার বলবাহী বোসন কণার একটির নাম ফোটন। এর কোনও আধান ও ভর নেই। বিপুল পরিমাণে মুক্ত ফোটনের সমষ্টি আলোকতরঙ্গ সৃষ্টি করে। একটি এক ওয়াটের ডিম লাইট সেকেণ্ডে বিলিয়ন বিলিয়ন ফোটন কণা নির্গত করে। কিন্তু মাত্র একটি ফোটন আলাদাভাবে পাওয়া কঠিন। শুধু গবেষণাগারেই ক্ষীণ আলোকতরঙ্গ থেকে একটা করে ফোটন কণার প্যাকেট বের করা সম্ভব। দ্বি-চিড় (আগে-পিছে দুটো দেয়াল, সামনেরটায় ক্ষুদ্র দুটো চিড় কেটে এর ওপর ক্ষীণ আলো ফেলা) পরীক্ষায় দেখা যায় যে, ফোটন পিছনের দেয়ালে তরঙ্গসদৃশ ব্যতিচারী ছাপ তৈরি করেছে। ১৯২৭-সালে পদার্থবিদ ক্লিংটন ডেভিসন ও লেস্টর জারমার দ্বি-চিড় পরিক্ষায় ইলেকট্রন ব্যবহার করেও এর তরঙ্গ ও কণা দ্বৈত চরিত্র দেখতে পান।

কণাবাদী বলবিদ্যা চিরায়ত বলবিদ্যা থেকে ভিন্ন কেন?
মূলত দৃশ্যমান বড় বস্তুগুলো দ্বৈত আচরণ করে না বলে আমরা নিউটনিয় চিরায়ত বলবিদ্যায় এর সঠিক ব্যাখ্যা পাই। অর্থাৎ দ্বি-চিড় বা দুই-ফালি বিশিষ্ট দেয়ালের দিকে একটা একটা করে অনেকগুলো ফুটবলে একজন আনাড়ি ফুটবলার শর্ট দিতে থাকলে, মাঝেসাঝে দু’একটা বল ফাঁক ভেদ করে পেছনের দেওয়ালে টানানো জালে গিয়ে পড়বে। এরপর একটা চিড় বন্ধ করে দিলে এই ফাঁকটি থেকে বল যাওয়া বন্ধ হবে। কিন্তু অন্যচিড়ে কোনও প্রভাব পড়বে না। যদি শুরু থেকেই কয়টা বল কোন ফাঁক থেকে গেলো তার সংখ্যা হিসাবে রাখা হয়, তবে প্রতিটি ফাঁক থেকে যে কয়টা বল পিছনের জালের দিকে গেছে তার যোগফল এবং জালে এতোক্ষণ যাবত জমা পড়া মোটবলের সংখ্যা সমান হবে। চিরায়ত বলবিদ্যা অনুসারে এটা বুঝতে খুব সমস্যা হয় না। কিন্তু অতিপারমাণবিক কণাদের দ্বি-চির পরীক্ষার ফলাফল ভিন্ন হয়। অণুকণারা যে ছিদ্র দিয়ে যাবে, সেই বরাবর একদম মধ্যখানে কিছু কণা উপস্থিত হয়। এর থেকে একটু দূরে অণুকণা কমে যায়। কিন্তু আরেকটু দূরে কণা আবার বেড়ে যায়। অর্থাৎ তরঙ্গসদৃশ (Web like) ব্যতিচার (interference) ছাপ তৈরি করে। মহাবিশ্ব গাঠনিক প্রাথমিক কণাদের চরিত্রের মধ্যেই তরঙ্গধর্মী আচরণ অন্তর্ভূত হয়ে আছে। কিন্তু মৌলিক কণাদের সমন্বয়ে গঠিত ভৌতজগত কেনই বা এমন, আসলে তাই কণাবাদী বলবিদ্যার মৌলিক ভাবনা।

বস্তুকণার অনিশ্চয়তা নীতি :
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি স্বীকার্য হলো অনিশ্চয়তার নীতি। ওয়ারনার হাইজেনবার্গ ১৯২৬-সালে প্রথম বর্ণনা করেন। এই নীতি অনুযায়ী কিছু কিছু চলকের (Variable) মান আমাদের পক্ষে কখনোই নির্দিষ্ট করে জানা সম্ভব নয়; যেমন: অবস্থান ও গতি। উল্লেখ্য, যদি কোনও কণিকার অনিশ্চয়তার সাথে এর ভরবেগের গুণ করা হয় (ভর ও বেগের গুণফল), তাইলে ফলাফল কখনোই প্লাংক ধ্রুবকের কম হতে পারবে না। অর্থাৎ যতোই সূক্ষ্মতার সাথে কণিকার গতি নির্ণয় করা হোক, ততোই এর অবস্থান নির্ণয়ের সূক্ষতা কমবে—একই ব্যাপার উল্টোভাবেও ঘটবে। মানে : অবস্থানের অনিশ্চয়তা অর্ধেক হলে, গতিবেগের অনিশ্চয়তা দ্বিগুণ হবে। এককে প্রকাশ করলে প্লাংক ধ্রুবকের মান অত্যন্ত ক্ষুদ্র (৬/১০, ০০০, ০০০, ০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০ এর মতো)। যা আমাদের নিত্য ব্যবহার্য কেজি বা সেকেন্ডের চেয়ে অবর্ণনীয়ভাবে ক্ষুদ্র। ধরা যাক ফুটবলের মতো একটি বড় বস্তুর ভর ১/৩ কেজি। এর অবস্থান এক মিলি পরিমাণ সূক্ষ্মতায় নির্ণয় করা গেলেও এর গতিবেগ ঘণ্টায় এক কিলোমিটারের বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়নভাগের একভাগ নির্ভুলতার সাথে মাপা যায়। কেননা একই এককে ফুটবলের ভর ১/৩ এবং এর অবস্থানের অনিশ্চয়তা ১/১০০০। প্লাংক ধ্রুবকের এতো শূন্য হিসাব করা কঠিন। তাই এগুলো বেগের ওপর চাপানো হয়।
অপরদিকে এই একই এককে ০.০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১ হলো ইলেক্ট্রনের ভর। তাই ইলেক্ট্রনের ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা হবে। অর্থাৎ ইলেক্ট্রনের অবস্থান একটি পরমাণু আকৃতির স্থানে নিশ্চিত করা গেলেও এর বেগ খুববেশি হলে ১০০০ কিমিঃ এর কম-বেশির মধ্যে নিশ্চিত করা যায় না। তাই এটা অবশ্যই নির্ভুল পরিমাপ নয়। কণাবাদী বলবিদ্যা অনুসারে যতোই তথ্য সংগ্রহ করি বা গণনক্ষমতা যতোই শক্তিধর হোক, আমরা একটি ভৌত ঘটনার ফলাফল নিশ্চয়তার সাথে হিসাব করতে পারবো না। সহজে বললে, অত্যন্ত সরল ঘটনার ফলাফলও প্রকৃতি আগেভাগে নিশ্চিত করে রাখে না। বরং কতোগুলো সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করে। তাই আইনেস্টাইন কণাবাদী অনিশ্চয়তার ব্যাপারে খুবই হতাশ ছিলেন এবং সমালোচনাও করেন। তিনি বলেন : ঈশ্বর প্রতিটি ভৌত ঘটনার ঘটার আগেই ছক্কা ছুঁড়ে দেখেন।

অনিশ্চিত মনে হলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স অভ্রান্ত :
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ঘটনাবলি প্রকৃতির সুনিশ্চিত নিয়ম মেনে চলে না মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটি তেমন নয়। বরঞ্চ এটাই বিনিশ্চিত এক অনন্য ধারণা দেয়। অর্থাৎ একটা বর্তমান ফলাফল দ্বারা একটার বদলে ভবিষ্যৎ বহুমাত্রিক সম্ভাবনা তৈরি করে। সম্ভাব্য বিষয়গুলো নিয়ে যাচাইবাছাই করা যায়। মূলত পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো এভাবেই আগায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। চেতন বা অবচেতনে সবাই তা মেনেও চলে। কিন্তু সবাই কী মেনে চলে এর ব্যাখ্যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া দেওয়া যায় না। এরদ্বারা একটি ঘটনার অনেকগুলো নিশ্চিত ফলাফল পাওয়া যায়। অতঃপর প্রয়োজনমতো যে কোনও একটার ওপর কাজ করা যায়। মহাবিশ্ব আসলে বহুমাত্রিক এবং সংখ্যাও অসীম। বহুমহাবিশ্বের ব্যাখ্যায় পরে আসছি। তবে আগে বস্তুজগতের একক বা পরমাণু সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

পরমাণুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও পর্যায় সারণি :
পর্যায় সারণি (Periodic Table) হচ্ছে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ একত্রে উপস্থাপনের আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত একটি ছক। আজ অবধি আবিষ্কৃত মৌলগুলোর ইলেকট্রন বিন্যাস ভিত্তি করে এবং ধর্মাবলী বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি এবং পর্যায়ে বিভক্ত করে এদের পারমাণবিক সংখ্যা ক্রমানুসারে পর্যায় সারণি সাজানো হয়েছে। এতে মোট ১১৮টি মৌল আছে। এগুলোর ২০টি অধাতু ও ৯১টি ধাতু এবং ৭টি অপধাতু। মূলত (Atom) পরমাণু দ্বারাই বস্তু গঠিত হয়। যে পদার্থ বিশ্লেষণ করলে ওই পদার্থ ছাড়া অন্যধর্ম বিশিষ্ট কোনও পদার্থ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক পদার্থ বা মৌল বলে; যেমন : হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ইত্যাদি। আবার দুই বা ততোধিক সংখ্যক মৌলিক পদার্থ নির্দিষ্ট ওজনের অনুপাতে রাসায়নিকভাবে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ধর্মী পদার্থ গঠন করে। অর্থাৎ যে পদার্থের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করলে দুই বা তার বেশি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়, তাকে যৌগিক পদার্থ বলে; যেমন : জল, খাদ্য লবন, এসিড, ক্ষার ইত্যাদি। ভৌতজগত আসলে মৌল ও যৌগের সমন্বিত রূপ। এটম গ্রিক শব্দ, এর অর্থ অবিভাজ্য। মানে আর ভাঙা যায় না। অতঃপর পরমাণুর মধ্যস্ত অতিপারমাণবিক কণা ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন আবিষ্কার হয়।

পরমাণুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :
১৮০৩-সালে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক জন ডাল্টন একটি পরমাণু তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এটা আধুনিক রসায়নের ভিত্তি হলেও তা পরমাণু অবিভাজ্যতা স্বীকার করেনি। এর মধ্যে পাঁচটি স্বীকার্য আছে। ১৮-শতাব্দীর শেষ অব্দি ডালটনের স্বীকার্যগুলো সবাই মেনে চলতো। কিন্তু ১৮৯৮ সালে জে জে থমসন ইলেক্ট্রন আবিষ্কার করলে ডালটনের ৩য় স্বীকার্য ভুল প্রমাণিত হয়। থমসনের মডেল অনুসারে পুডিংয়ের ভিতর কিশমিশ যেমন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকে, পরমাণুর মধ্যেও তদ্রূপ নিরবচ্ছিন্নভাবে বন্টিত ধনাত্মক আধানের মধ্যে ইলেক্ট্রন ছড়িয়ে আছে। আরও সহজ করতে তিনি তরমুজের মধ্যকার গঠনের উদাহরণ দেন—তরমুজের জলীয় অংশ বা লাল অংশ হলো ধনাত্মক এবং বিচিগুলো ঋণাত্মক চার্জবাহী কণা। মূলত এটিই ছিল প্রথম উপস্থাপিত পরমাণু মডেল। ১৯০৯ সালে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও তার দুই সহকর্মী থমসন পরমাণু মডেল প্রমাণের লক্ষ্যে আলফা কণিকা বিক্ষেপণ পরীক্ষা সম্পাদন করেন। পরীক্ষালবদ্ধ ফল থেকে ১৯১১ সালে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন : পরমাণুর কেন্দ্র আছে, এই কেন্দ্রের নাম নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের মাঝে ধনাত্মক আধানের ও ঋণাত্মক কণা এবং এর বাইরে ইলেকট্রন অবস্থান করে। ইলেকট্রন ভরশূন্য। তাই নিউক্লিয়াস কেন্দ্রস্থিত প্রোটন ও নিউট্রনের ভরই পারমাণবিক ভর। নিউক্লিয়াস অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং পরমাণুর অভ্যন্তরে বেশিরভাগ জায়গাই ফাঁকা। যেমন সৌরজগতের কেন্দ্র সূর্য। গ্রহগুলো বিভিন্ন কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তদ্রূপ নিউক্লিয়াস কেন্দ্র করে ইলেকট্রনগুলো বিভিন্ন কক্ষপথে ঘোরে। ধনাত্মক আধানযুক্ত নিউক্লিয়াসের প্রতি ঋণাত্মক আধানের ইলেকট্রন আকর্ষণ বল অনুভব করে। এই আকর্ষণ বল কেন্দ্রমুখী। এই কেন্দ্রমুখী বলের কারণে পৃথিবী যেভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, ইলেকট্রনরাও সেভাবে নিউক্লিয়াস কেন্দ্র করে ঘোরে। সৌরজগততুল্য বলায় এটাকে সৌরমডেলও বলা হয়। মূলত রাদারফোর্ডই সর্বপ্রথম নিউক্লিয়াস সম্পর্কে ধারণা দেন। তাই এটা নিউক্লিয়ার মডেল নামেও পরিচিত। এই মডেল প্রথম পরমাণু সম্পর্কিত যুক্তিযুক্ত ও পরিষ্কার ধারণা দিয়েছে।

নেইলস বোরের পরমাণুবাদ :
১৯১৩ সালে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী নেইলস বোর পরমাণু মডেলের জন্য দুটি প্রস্তাব পেশ করেন। যা বোরের স্বীকার্য নামে পরিচিত।
-স্থায়ী অবস্থা স্বীকার্য (Postulates of Stationary States)
-কম্পাঙ্ক স্বীকার্য (Postulates of Frequency)
এই মডেল অনুসারে নিউক্লিয়াসের চারপাশে কয়েকটি অনুমোদিত কক্ষপথে ইলেকট্রন ঘোরে। অতঃপর তিনিই সর্বপ্রথম বর্ণালী সম্পর্কে ধারণা দেন।

পরমাণুর মধ্যে ইলেক্ট্রনের বিন্যাস :
কোনো একটি পরমাণুর নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেক্ট্রন উক্ত পরমাণুর বিভিন্ন শক্তিস্তরে অন্তর্ভুক্ত নির্দিষ্ট উপশক্তিস্তরের বিভিন্ন কক্ষপথে নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো থাকে। ইলেক্ট্রনের এই সাজানো অবস্থাই পরমাণুর ইলেক্ট্রন বিন্যাস বলা হয়। ইলেক্ট্রন বিন্যাস পাওলির বর্জন নীতি, আউফবাউ নীতি এবং হুন্ডের নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। (এবিষয়ে আগ্রহ আছে গুগলে দেখে নিতে পারেন)।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা মহাবিশ্বের প্রাথমিক কণাদের তালিকা :
এতোক্ষণ মূলত পরমাণু ও ইলেক্ট্রন সম্পর্কে বললাম। যা অনেকটাই সহজবোধ্য। কিন্তু পরমাণু ভেঙে আরও ভিতরে প্রবেশ করা যায়। ফলে আমরা মহাবিশ্বের প্রাথমিক বা মৌলিক কণাগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি। মূলত ইলেকট্রন আবিষ্কার হওয়ার ফলেই বৈজ্ঞানিকগণ পরমাণুর মডেল কী হবে তা নিয়ে গবেষণা করেন। নইলে হয়তো আজও অবিভাজ্য পরমাণু ধারণায় আমরা থাকতাম। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে বিজ্ঞানীদের অতিপারমাণবিক কণার স্বরূপ নির্ণয়ের উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত দুইশ’র বেশি অতিপারমাণবিক কণার অস্তিত্ব মিলেছে। দিনে দিনে এই সংখ্যা বাড়ছে। অবশ্য কণাদের বেশিরভাগই মৌলিক নয়। তদুপরি মহাবিশ্ব গঠনে এদের সবারই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি কণার আবার প্রতিকণা আছে; যেমন : পজিট্রন e+ ইলেক্ট্রনের e- প্রতি কণা। কিন্তু প্রতিকণার অস্তিত্ব অনুভব হলেও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বাইরে। তাই প্রতিকণা হিসাবের বাইরে রেখে ১৭-টি মৌলিক কণার নিশ্চিত ব্যাখা দেওয়া যায়। এরা বস্তুজগতের গঠন প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা রেখেছে। তবে ভবিষ্যতে আরকতো নতুন কণা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে যুক্ত হবে, তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত নয়। স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো পর্যায় সারণির মৌলদের তালিকার মতো। দেখা যাক, এই মডেলে কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে।

কণার শ্রেণিবিভাগ :
উপরুল্লেখিত ছকের নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা মহাবিশ্বের মৌলিক কণাদের তালিকা। এরমধ্যে প্রথম তিনটি কলামের বারোটি কণিকার নাম ফার্মিয়ন কণা এবং পরের কলামদুটোর পাঁচটি বোসন কণার অন্তর্ভুক্ত। ফার্মিয়ন কণার অপর নাম ভরবাহী কণা এবং বোসনদের নাম বলবাহী কণা। ভরবাহী কণারা বস্তুরাজির ভর বহন করে। বলবাহী কণারা বস্তুর মধ্যে শক্তি এবং পরস্পরের মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণে ভূমিকা রাখে। ফার্মিয়নরা যেন একে অন্যের সঙ্গে জোড়া লাগতে পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বোসনদের। অর্থাৎ ফার্মিয়নরা মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয় বোসনদের সাহায্যে। এখানে লেগো সেট কৌশল উল্লেখ করা যায় : লেগো সেটের একেকটি গুটি (Block) যদি ফার্মিয়ন হয়, তবে এর প্রতিটি গুটির সাথে খাঁজগুলো বোসন। কেননা খাঁজগুলোর সাহায্য ছাড়া লেগোর গুটিগুলো পরস্পরের সাথে জোড়া লাগে না। আসলে মহাবিশ্বটা বড়সড় লেগো সেটসদৃশ। ফার্মিয়নদের স্পিন অর্ধপূর্ণ সংখ্যা (১/২) এবং ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। আর বোসনরা পূর্ণসংখ্যায় স্পিন করে এবং বোস-আইনেস্টাইন পরিসংখ্যান (১) মেনে চলে। উপরের তালিকা এর দৃষ্টান্ত। বোস থেকে বোসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সত্যেন বোসের নামের সাথে এই কণার নাম যুক্ত।

কোয়ার্ক ও লেপ্টন :
কোয়ার্ক ও লেপ্টন উভয়ই ফার্মিয়ন কণা। ফার্মিয়ন পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির নামানুসারে রাখা হয়। ফার্মি প্রথম পরিসংখ্যানগত সূত্র তৈরি করেন যা ফার্মিয়নগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এই কণাগুলো পাওলি বর্জন নীতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কণারা একই কোয়ান্টাম স্থান দখল করে না। উপরের তালিকার বামদিকের প্রথম কলামের সবগুলো (আপ ও ডাউন হলো কোয়ার্ক এবং ইলেকট্রন ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো লেপ্টন) প্রথম প্রজন্মের মৌলিক কণা নামে পরিচিত। এরাই মহাবিশ্বের সবধরনের বস্তুকণা তৈরিতে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়। আমরা জানি, মহাবিশ্বের সবকিছুই পরমাণু দিয়ে গঠিত। পরমাণুর ভেতরে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এদের মধ্যে শুধুমাত্র ইলেকট্রনই মৌলিক কণা। বাকি দুটি অবিভাজ্য নয় বলে ভাঙলে আপ ও ডাউন কোয়ার্কের অস্তিত্ব মেলে। অতএব কোয়ার্ক ও ইলেকট্রন পরমাণু তথা মহাবিশ্বের বস্তুরাজি গঠনের প্রকৃত উপাদান। বাকি কলামদুটোর ১মটার উভয় কোয়ার্ক ও লেপ্টন কণা (চার্ম, স্ট্রেইঞ্জ, মুয়ন, মুয়ন নিউক্ট্রিনো) দ্বিতীয় প্রজন্মের। একেবারে শেষের কলামের উভয় কোয়ার্ক ও লেপ্টন (টপ, বটম, টাউ, টাউ নিউক্ট্রিনো) ৩য় প্রজন্মের ফার্মিয়ন কণা। মূলত ২য় ও ৩য় প্রজন্মের ফার্মিয়ন কণারা প্রথম প্রজন্মের কণাদের মতো একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। পার্থক্য শুধুই (Mass) ভরে। কিন্তু আধান (Charge) ও স্পিন একই। এদের ভর প্রথম প্রজন্মের কণার চেয়ে বেশি। ক্ষয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এরা কম ভরের মৌলিক কণায় পরিণত হয়।

প্রকৃতির মৌলিক বল :
প্রকৃতিতে হরেকরকম বল আমরা দেখি। কিন্তু এদের বেশিরভাগই মৌলিক বল নয়। বরং মৌলিক বল থেকে এদের উৎপত্তি। মূলত মাত্র চারটি মৌলিক বলের অস্তিত্ব প্রকৃতিতে রয়েছে। অন্যসব বল উৎপত্তি হয় এদের কোনো একটি থেকে। প্রকৃতিতে মহাকর্ষ বল ছাড়াও আরও তিনটি মৌলিক বল আছে, যথা : তড়িৎ চৌম্বক বল, সবল নিউক্লীয় বল ও দুর্বল নিউক্লীয় বল। তবে মহাকর্ষ নামক মৌলিক বলের অনুপস্থিতি কণাবাদী বলবিদ্যার অন্যতম সীমাবদ্ধতা। অবশ্য মৌলিক কণাগুলোর ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব নগন্য বা নেই বললেই চলে। তাই এনিয়ে আলোচনা আপাতত না করলেও চলে। সম্ভাব্য মহাকর্ষ বল কণার নাম গ্রাভিটন দেওয়া হয়েছে, যা এখনও অধরা। তবে আবিষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ফার্মিয়ন কণারা তিন ধরনের মৌলিক বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না। কারণ প্রত্যেকটি ফার্মিয়ন বা ভরবাহী কণা আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। আর মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার ঘটনাটি বলবাহীদের ওপরই নির্ভর করে; উদাহরণ স্বরূপ : তড়িৎ চৌম্বক বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে কেবল সেইসব ফার্মিয়ন, যাদের মধ্যে তড়িৎ আধান বা চার্জের অস্তিত্ব আছে। নিউট্রিনোর মতো চার্জশূন্য ফার্মিয়নদের ওপর তড়িৎ চৌম্বক বলের কোনো প্রভাব নেই। আবার সবল নিউক্লীয় বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে হলে ফার্মিয়নদের সম্পূর্ণ আলাদা আরেকটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। এর নাম কালার চার্জ। কোয়ার্কদের মাঝে এদের অস্তিত্ব থাকে। তাই সবল বলের মিথস্ক্রিয়ায় কোয়ার্ক ছাড়া অন্য ফার্মিয়নরা অংশ নিতে পারে না।
এবারে দৃষ্টি দেওয়া যাক দুর্বল বলের দিকে। সব ফার্মিয়ন কণারা এই বলের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। বিশেষ করে যে সব মৌলিক কণাগুলো তড়িৎ চার্জ বা কালার চার্জ বহন করে না, তাদের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার একমাত্র উপায় এটি; যেমন : নিউট্রিনো।

বোসন কণা :
মৌলিক বলগুলো মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয় স্ট্যান্ডার্ড মডেলে উল্লেখিত বোসন কণাদের মাধ্যমে। সেজন্য এদের বলবাহী কণা বলা হয়। মোট চার ধরনের বোসনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। ফোটন, ডব্লিউ ও জেড বোসন, গ্লুয়ন ও হিগস বোসন। ফোটনরা তড়িৎচৌম্বক বলের বাহক। এরা ভরহীন ও চার্জশূন্য কণা। এ কারণে তড়িৎচৌম্বক বলের পাল্লা অসীম। অর্থাৎ, দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে এদের প্রভাব কমতে থাকে। কিন্তু কখনোই প্রভাব শূন্য হয় না। ডব্লিউ ও জেড বোসন কণারা ফোটনের চেয়ে আলাদা। এরা ভরহীন নয় বরং বেশ ভারী। এরাই দুর্বল নিউক্লীয় বল ক্রিয়াশীল করে। এ ধরনের বোসনগুলো ভারী হওয়ার কারণে সব মৌলিক বলের মধ্যে দুর্বল বলের পাল্লা সবচেয়ে কম (১০-১৮ মিটারের কাছাকাছি)। সবল বলের পাল্লাও বেশ কম, মাত্র ১০-১৫ মিটারের কাছাকাছি। এদের বহনকারী বোসন কণার নাম গ্লুয়ন। সবল নিউক্লীয় বল গ্লুয়ন ভরশূন্য হলেও কালার চার্জ বহনের দরুণ খুব অল্পজায়গা জুড়ে ক্রিয়াশীল থাকে।
বোসনদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজনের নাম হিগস বোসন। অন্যান্য বোসন কণার সাথে এর অনেকটাই পার্থক্য আছে। অন্যসব বোসন কণার স্পিনের মান ১ হলেও এদের মান শূন্য। এরা কোনো মৌলিক বলের সাথে সম্পৃক্ত না। তবে মহাবিশ্বের গাঠনিক কণাগুলোর ভর প্রদান করে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে উল্লেখ্য গ্লুয়ন ও ফোটন কণা বাদে আর সবকণার ভর আছে। এদের ভরও নির্দিষ্ট কারণে হয়। অকারণে মহাবিশ্বের কোনোকিছুই হয় না। হিগস বোসন কণা অন্যদের ভরের কারণ। গেলো দশকে উইরোপের সার্‌ন ল্যাবের লার্‌জ হেড্রন কলাইডারে প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটিয়ে এই কণার আবিষ্কার হয়। প্রথম দিকে এটাকে অনেক কলামিস্ট ঈশ্বর কণা নামে অভিহিত করে। তবে এসব কথাবার্তা এখন খুববেশি শোনা যায় না।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে বহুমহাবিশ্বের ধারণা :
বিগ ব্যাং শব্দটি আজকাল সবাই শুনেছে। মূলত মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্ব এবং সম্ভাব্য বহুমহাবিশ্ব (Multiverse), অনন্ত মহাবিশ্ব (Infinit Universe) কিংবা সমান্তরাল মহাবিশ্বের (Paralell Universe) উৎপত্তি। তবে এসব বুঝতে কৃষ্ণগহ্বরের কণাবাদী অবস্থা, মহাকর্ষের আরোহ (Induction) ব্যাখ্যা এবং স্থানকালের স্ফীতি সংক্রান্ত পূর্বধারণা থাকতে হয়। এর প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ লেখা যায়। আসলে এসব গবেষণামূলক জ্ঞানীয় বিষয়। না জানলেও কারও ডাক্তার/এঞ্জিনিয়ার হতে সমস্যা নাই।

মহাজাগতিক স্ফীতি এবং অনন্ত মহাবিশ্ব :
প্রথমত বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ৮০ দশকে ইনফ্লেশন বা স্ফীতিতত্ত্ব নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক গণিতগুলো সমাধান করতে গিয়েই ক্রমশ এই অদ্ভুতুরে ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে। এই গবেষকদের মধ্যে বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ভিলেংকিন ও আদ্রে লিন্ডে অনেকটা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন যে, মহাজাগতিক স্ফীতি একবার শুরু হলে আর থামে না। এ ব্যাপারটাই আজকাল বিজ্ঞানীদের কাছে “চিরন্তন স্ফীতি” (Eternal Inflation) নামে পরিচিত। বহুমহাবিশ্বের ধারণা মূলত এই চিরন্তন স্ফীতিতত্ত্বেরই স্বাভাবিক এক গাণিতিক পরিণতি মাত্র। আমাদের মহাবিশ্ব কণাবাদী ভাঙাগড়া (Quantum Fluctuation) দ্বারা স্থানকালের শূন্যতার ভিতর দিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তাই এই একই প্রক্রিয়া একাধিকবার ঘটতে পারে। প্রথমে ট্রিয়ন এবং পরে আদ্রে লিন্ডে ও আলেকজাণ্ডার ভিলেংকিনের গবেষণা থেকে একাধিক মহাবিশ্বের ধারণা আসে। সৃষ্টির উষালগ্নে ইনফ্লেশনের দ্বারা সম্প্রসারিত বুদ্বুদ (Expanding Bubbles) থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতই অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টির হয়েছে, যেগুলো একটার থেকে অপরটা সংস্পর্শবিহীন অবস্থায় দূরে সরে গেছে। এ রকম অগণ্য মহাবিশ্বের একটিতে আমরা বাস করি!

আইনেস্টাইনের স্থানকালের বক্রতা বনাম শিশুমহাবিশ্ব :
আইনেস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ (The Theory of General Relativity) অনুসারে স্থানকাল চাদরসদৃশ (Fabrics) এটাকে ম্যাট্রিকও বলা হয়। যা মহাকর্ষের কারণে বক্র হয়। এই বক্রতার তারতম্য ঘটে মহাকর্ষের পশ্চাতপটের (Background) তীব্রতা অনুযায়ী। গত নব্বইদশকে দেশকাল (spacetime) কীকরে ওঠানামা (Fluctuate) করে, এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কতিপয় বিজ্ঞানী (এডওয়ার্ড ফার্হি, এলেন গুথ এবং জেমাল গুভেন) দেখলেন, স্থানকাল শুধু বক্র বা প্রসারিত হয় না, বরং টুকরো টুকরোও হতে পারে। মাঝেমধ্যে বৃহত্তর মহাবিশ্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে খুব ক্ষুদ্র স্থান বা দেশ জন্ম হতে পারে।

কণাবাদী ব্লাকহোলের ইতিবৃত্ত বনাম শিশুমহাবিশ্ব :
স্টিফেন হকিং বলেন : ব্লাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর পুরাপুরি কৃষ্ণ বা কালো নয়। আমাদের জগত থেকে কোনও বস্তু ব্লাকহোলে পতিত হলে তা মহাকর্ষজনিত অসীম বক্রতার কবলে পড়ে এক অনন্য অবস্থা লাভ করে। অথবা এককথায় এর কোনও ইতিহাস থাকে না। সুপার স্ট্রিং তত্ত্ব মতে কণারা একমাত্রার তন্তু বা স্ট্রিং দ্বারা গঠিত। এই তন্তুগুলো গিটারের তারের মতো ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই তরঙ্গগুলোই কণাদের বৈশিষ্ট গঠন করে। কৃষ্ণগহ্বরের অনন্য মহাকর্ষের অসীম বক্রতা উক্ত তন্তুগুলোর ভিন্নরকম তরঙ্গবৈশিষ্ট প্রদান করে। ফলে মৌলিক কণাদের বৈশিষ্টই পাল্টে যায়। তারপর ব্লাকহোল থেকে বলবাহী কণিকার (হকিং বিকিরণ) যে নতুন সংস্করণের বিকিরণ হয় সেগুলোর সমন্বয়ে স্বেতগহ্বর তৈরি হতে হতে পুরো ব্লাকহোলই শূন্যে মিলে যায়। তাতে আমাদের হিসাবে অসীম সময়ের প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় বিকিরণ হওয়া কণিকারা আলোর চেয়ে বেশি গতি লাভ করে। অনিশ্চয়তা নীতি কণাগুলোর আলোর চেয়ে বেশি গতিবেগে ক্ষুদ্র দূরত্ব অতিক্রম অনুমোদন করে। ফলে নতুন কণারাজি ব্লাকহোল ও এর ঘটনাদিগন্ত থেকে পলায়ন করতে পারে। অতঃপর কথিত নির্গত কণাগুলো যে স্থানে গিয়ে জমা পড়ে, সেই স্থান বক্র করে অথবা ভেঙে টুকরো করে একটি শিশু মহাবিশ্বের সূচনা করতে পারে। কেননা আমাদের জ্ঞাত মহাবিশ্বের কণিকারাজির চরিত্র আর ব্লাকহোল থেকে নির্গত কণিকাদের চরিত্র এক নয়। ব্লাকহোলে পতিত হলে কণাদের পুরানো বৈশিষ্টের ইতিবৃত্ত এক অনন্যতায় হারিয়ে যায়। অতঃপর ব্লাকহোল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কণার নির্গমন ঘটে। এরাই নতুন কালের সূচনা করে। এজন্য মহাবিস্ফোরণের প্রয়োজন হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং ঘটে চলেছে। আজ থেকে ১৩.৮০ বিলিয়ন বছর আগে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটে, সেটাই আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা বলা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে বিগ ব্যাং চুল্লিতে আমাদের মহাবিশ্বের কণাদের মধ্যে ভিন্ন একপ্রকার জৈব কণার উৎপত্তি ঘটিয়েছে। এগুলোই এই মহাবিশ্বে জীবমণ্ডল তৈরির জন্য দায়ী। তবে এই একই প্রক্রিয়া অন্যান্য মহাবিশ্বে ঘটবে, তা বলার সময় আসেনি। তবে প্রতিটি মহাবিশ্বের আকার ও বৈশিষ্ট এক নয়, আপাতত এভাবে ব্যাখ্যা করা সঙ্গত। স্টিফেন হকিং ১৯৯৪ সালে “কৃষ্ণগহ্বর এবং শিশু মহাবিশ্ব” শিরনামের বইয়ের মধ্যে এর সবিস্তার বিবরণ দেন। (বিষয়টি একটু কঠিন, তবে কৌতুহল থাকলে বইটি পড়ে দেখতে পারেন, গুগলে এর পিডিএফ কপি পাওয়া যায়)।

ফলস ভ্যাকুয়াম বুদ্বুদের মাধ্যমে শিশুমহাবিশ্বের জন্ম হয় :
ক্যালিফোর্ণিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির স্বনামখ্যাত পদার্থবিদ শন ক্যারল এর ওপর “ফ্রম ইটারনিটি টু হেয়ার” নামে একটি বই লিখেছেন। এই বইয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, ডি-সিটার স্পেস (যে স্থানে খুব স্বল্পপরিমান ধনাত্মক ভ্যাকুয়াম এনার্জি লুকিয়ে থাকে) থেকে কীকরে ফলস ভ্যাকুয়াম বুদ্বুদের মাধ্যমে শিশুমহাবিশ্বের জন্ম হওয়া সম্ভব। এর ব্যাখ্যা খুবই জটিল গণিতে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে নিচের চিত্রে দেখানো হলো :

স্ট্রিং তত্ত্ব ও এম-তত্ত্ব :
স্ট্রিং তত্ত্বিকরা তাদের বিখ্যাত এম-তত্ত্বের মেলবন্ধনের মাধ্যমে এ বিষয়ে আরো অনেক দূর এগিয়েছেন। তাদের গণনা থেকে দেখা গেছে, কোয়ানটাম দোদুল্যময়তার মাধ্যমে এমনকি ১০৫০০ টির মতো ভ্যাকুয়াম স্তরের (vacuum state) উদ্ভব ঘটতে পারে। এ স্তরগুলো থেকে জন্ম নিতে পারে আলাদা মহাবিশ্ব। আর প্রতিটি মহাবিশ্বে একেক ধরণের পদার্থবিজ্ঞান সূত্র কার্যকর হতে পারে। স্টিফেন হকিং তার ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ গ্রন্থে এই বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন : “এম-তত্ত্বের নিয়মগুলো তাই ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ধারণাকে সম্ভাব্য করে তোলে। মহাবিশ্বগুলোর প্রকৃতি কীরকম হবে তা নির্ভর করে অন্তঃস্থানের (internal space) বক্রতার প্রকৃতির উপর। কাজেই, এম-তত্ত্ব থেকে পাওয়া সমাধান অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তার সংখ্যা হতে পারে এমনকি ১০৫০০ টিও। এর মানে হল, আমাদের চারপাশে ১০৫০০ টির মতো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে এবং প্রতিটির উপর কাজ করতে পারে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক সূত্র।“

শূন্যস্থানে সর্বদাই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন ঘটে :
মূলত কোয়ান্টাম তত্ত্বানুযায়ী শূন্যস্থান বলতে কোয়ান্টাম শূন্যতা বলে। আমরা শূন্য বলতে যা বুঝি সেখানে ভরবাহী কণিকা না থাকলেও বলবাহী কণিকার অস্তিত্ব থাকবেই। এই বলবাহী কণাগুলো অন্য এক ব্লাকহোল থেকে বিকিরণ হয়ে এসেছে। শূন্যতার প্রতিটি সূক্ষ্মস্তরে সর্বদা নানান প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। কিন্তু কী সেই নানান কর্মকাণ্ড, যা শূন্যতার মাঝেও প্রতিনিয়ত অশান্ত অবস্থার কারণ হয়? আসলে শূন্যস্থানের সূক্ষ্মস্তরে প্রতিনিয়ত শক্তি ও ভরের অদল-বদল ঘটছে। এর ফলে সেখানে শক্তি প্রতিমুহূর্তেই ভর বা কণায় রূপান্তরিত হচ্ছে। আবার প্রকৃতিতে প্রতিটি কণার বিপরিতে প্রতিকণার অস্তিত্ব আছে। একটি কণা অন্য একটি কণার বিপরীত তখনই হয়, যখন এদের মধ্যকার ভর সমান হলেও চার্জ বিপরীত হয়—যেমন পজিট্রনের চার্জ ধনাত্মক কিন্তু ইলেকট্রন হলো ঋণাত্মক কণা—এরা পরস্পর বিপরীত কণা। উল্লেখ্য, দুটি বিপরীত কণার স্পর্শ গেলে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর শূন্যতার মাঝে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কণাদুটোর ভরের সমপরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে (আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর=শক্তি সমীকরণ E=mc2 অনুসারে)। মোটকথা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমেই আমাদের এই মহাবিশ্বের ভৌত অবকাঠামো সৃষ্টি হয়েছে।
মহাবিস্ফোরণ কী করে ঘটে?
উল্লেখ্য ব্লাকহোল থেকে অনন্য কণাগুলো নির্গত হয়ে নতুন স্থানে জড় হয়ে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের দ্বারা মহাবিস্ফোরণ ঘটায়। এভাবেই আমাদের মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীল স্থানকালের সূচনা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আদিতে মহাজাগতিক শূন্যতায় কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ফলে যেসব কণা সৃষ্টি হয়েছিলো, সেগুলোই আমাদের এই মহাবিশ্ব দৃশ্যমান করেছে। প্রতিনিয়ত এভাবেই অসংখ্য নয়া মহাবিশ্ব সৃষ্টি হচ্ছে! অতঃপর এরা বিভিন্ন আকার-আয়তনে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
পরিশেষে বলতে হয়, যে মহাবিশ্বে আমাদের বসবাস সেটা আদতে অভিনব ঘটনা নয়। বরং আরও অগণিত মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। আর প্রতিটির ভৌতগাঠনিক প্রক্রিয়া ভিন্নতর। তবে এ সম্পর্কে শুধুই গাণিতিক ধারণা দেওয়া যায়, সশরীরে উপস্থিত হওয়া যায় না!

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge