১.
একদিন মা বলেছিল, না বলে কখনো কিছু নিতে হয় না। এই কথা মা কেনো বলেছিল সেটা বলি। তখন আমার বয়স সাত আট হবে। একবার ছোট মামার সাথে কলসকাঠির হাটে গিয়েছিলাম। বিরাট বড় হাট। শনিবার আর মঙ্গলবার হাট বসত। দুর দুরান্ত থেকে লোকজন আসত হাটে। বড় বড় নৌকা আসত মাল বোঝাই করে। সেই হাটে কি পাওয়া যেতো না! সবই পাওয়া যেতো। এমনকি ছোটদের প্লাস্টিকের খেলনাও পাওয়া যেতো। সেবার হাট থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। ছোট মামা এমনই একজন মানুষ যিনি সবকিছু করেন ধীর লয়ে। কোনো কিছুতে তাৱ কোনো তাড়া নাই। ঢাপরকাঠি থেকে বরিশাল শহরে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসার প্লান থাকলে সে প্রায় দুই মাস আগে থেকে প্রিপারেশন নিতেন। অথচ লঞ্চে মাত্র চার ঘন্টার পথ।
মামার ইয়ার বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে রাত বেড়ে গিয়েছিল সেদিন। মা জেগে বসেছিলেন আমার জন্য। ঘরে ফেরার পর মা বললেন, তোমার হাতে এটা কি!
আমি বললাম খেলনা।
মা বললেন তোমার মামা কিনে দিছে!
আমি বললাম না।
কখন যে খেলনাটা হাতে নিয়েছি নিজেই জানি না। মামাওতো কিছু বলল না! খেয়ালই করেনি হয়ত। সেদিন মা বলেছিল, না বলে কখনো কিছু নিতে হয় না। মামা অবশ্য পরের হাটেই খেলনার দোকানে গিয়ে দাম দিয়ে এসেছিলেন।২.
একবার খেলতে গিয়ে রাস্তার এক ছেলের সাথে ঝগড়া লেগে গেছিল। সেই ছেলেটি ছিল ডাকাবুকা টাইপ। সাহসী। আমাকে ধাক্কা মেৱে ফেল দিল এবং কষে একটা কিলও মেরেছিল। তখন আমি নিতান্তই ছোট। কাঁদতে কাঁদতে মার কাছে এসে ঘটনা বললাম।
মা জানতে চাইলেন আমিও মেরেছি কিনা।
আমি বললাম, না মারি নি।
মা বললেন এখনই গিয়ে তার সাথে মিটিয়ে আসো। আর কখনো ঝগড়া কৱবা না।
মা জানেন না যে, শিখ ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, কেউ যদি তোমাকে অন্যায়ভাবে এক গালে একটা চর মারে তুমি তার অপর গালে চারটি চর মেরো। অথচ মা আমাকে অহিংস হতে বলছেন।
আমার মা কখনো স্কুলে যায়নি। আদৰ্শলিপির বই পড়েনি। মরালিটি জিনিসটা মা জানল কিভাবে! কে শেখালো তাকে! আমার মনে হয় মরালিটি হচ্ছে এক ধৱনেৱ পরগাছা। দুৰ্বল গাছকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুষে খায়, ছিবড়ে করে ফেলে। গাছটা ওই মরালিটির জন্যই বেড়ে উঠতে পারে না।
আমি তখন ঢাকায় চাকরি করি। লোভনীয় চাকরি। সামনে ঐশ্বৰ্য্যেৱ সিংহদুয়ার। লুটে পুটে খাও। অথচ আমি বাসে চড়ে অফিসে যাই। কয়েকবার পকেটমারও হয়েছে। বন্ধুরা বলল, সাধু সেজে লাভ কী হচ্ছে! আমি সঙ্কুচিত হয়ে বললাম, কেমন বাধো বাধো ঠেকে আমার।৩.
তাইত ঢাকায় আমার গাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কিছুই হয়নি। ইমিগ্রেশন হওয়ার পর পৈতৃক জমি বিক্রী করে কানাডা এসেছিলাম সপরিবারে। মায়ের কাছ থেকে শুধু পেয়েছিলাম অই বাধো-বাধোটুকু। একটা অপ্রতিরোধ্য ভাইরাসের মতো আমার ভিতরে ঢুকে জিনেৱ মধ্যে সেধিয়ে সেই যে বাসা করে ফেলল, আজও বজ্জাত ভাড়াটের মতো থানা গেড়ে বসে আছে। তাড়ানো যায় না। অথচ আমার এখনকার বন্ধুদের দেখেছি কেমন প্রশান্ত চেহারা তাদের, কেমন নিশ্চিন্ত মুখ, কেমন উজ্জল সব শরীর, কথাবাৰ্তায় কী আত্মবিশ্বাস! টাকায় কী না হয়। পাশাপাশি আমার মতো বাধো-বাধো টাইপ লোকরা কেমন অনুজ্জল, ক্ষয়াটে, ধুসর, সারাক্ষন বিব্রত আর আত্মবিশ্বাসহীন নন-এন্টিটি।