একদিন পাইনের গায়ে
শুভদীপ
কলেজে যাওয়ার পথে এক বয়স্ক ভদ্রলোক চোখে পড়তেন প্রায়শই।বয়স জিজ্ঞাসা না করলেও মুখের কোঁকড়ানো ভাঁজগুলোই ছিল তাঁর হিসেবের দস্তাবেজ।চোখের কালকুঠুরিতে অনুরণিত হত আশি বছরের মূল্যবান অভিজ্ঞতা।ছেঁড়া একখানা প্যান্ট আর লুপ্তপ্রায় রংচটা জামাটায় কেমন যেন একটা সেকেলে গন্ধ।পাশ দিয়ে যেতে নাক ঢাকবেন অনেকেই।হ্যাঁ; এটাই স্বাভাবিক।তবে বলে রাখি আশিখানা বছরের উঁচু নীচু জংলি রাস্তা দিয়ে বিনা হাতিয়ারে হেঁটে গেলে অমন একটু আধটু গন্ধ গায়ে রাখতে হয় বৈকি!নইলে আপনার সাথে সেই লড়াকু মানুষটার পার্থক্য কোথায়!একটা মস্ত অফিসের এন্ট্রান্স করিডর লাগোয়া একফালি জমিতেই পাকাপাকি আস্তানা ছিল তাঁর।চারিদিকে কংক্রিট আর দিনরাত সালফার যুদ্ধ।অ্যাসিডের শিকার মেয়েটিকে দেখে আঁতকে উঠেছেন অনেকবার।মনে মনে বলেছেন এই পরিণতি তো একদিন সবারই হবে;যখনই বৃষ্টি নামবে মুষলধারে,সাথে নামবে গরম সালফিউরিক অ্যাসিড; কেউ রেহাই পাবেনা!
দিনরাত উপুড় হয়ে শুয়ে সবুজ ঘাসে কি যেন খুঁজে বেড়াতেন একনাগাড়ে।বিস্মিত হয়ে নেমেছিলাম একবার।কাছে যেতে বুঝেছিলাম ওনাকে সবাই পাগল বলেই জানে;নইলে একটা বছর বাইশের সুস্থ মানসিকতার যুবক কখনও ঐ ভাবে ঢিল মারতে পারে তাঁকে?যদিও ছেলেটির মানসিক সুস্থিতি নিয়ে সন্দেহটা আজও রয়েই গেছে।ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে তাঁর মুখেই শুনেছিলাম তিনি নাকি দিন সাতেক আগে একটা পাইনের বীজ পুঁতেছিলেন এখানে।রোজ মাটির রুক্ষতায় চোখ ঠেকিয়ে খোঁজ করেন অঙ্কুরিত চারার।ঠিক যেমন আমি বা আপনি মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে গাছেদের ঐ কি সব দেখতাম,তেমনই।খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলেছিলাম
-” এই পরিবেশে কি পাইনটা হবে গো দাদু?”
ফ্যালফ্যালে চোখগুলো ছিল তীব্র আশাবাদী।শান্ত-কম্পিত গলায় বলেছিলেন
-“আদর দিলে মরুভূমিতেও চারা ওঠে।উঠবে উঠবে;ঠিক উঠবে।”
ইতিমধ্যেই কলেজের প্রথম ক্লাস শেষ।দ্বিতীয়টা ধরতেই হবে।বড় রাস্তায় ওঠার আগে দেখি লোকটি মাটির মধ্যে মুখ লাগিয়ে হাসতে হাসতে বলছেন
-” শুনছিস? উঠে আয়; ভয় নেই,আমি আছি তো!”
আজ প্রায় কুড়ি বছর কেটে গেছে। বৃদ্ধ মানুষটা মিশে গেছেন প্রকৃতিতে, প্রকৃতির নিয়মেই। আমরা প্রযুক্তিতে এগিয়ে গিয়েছি আরও অনেকটা। আর সেই পাইনের বীজ? সত্যিই সে আজ এক মস্ত বড় গাছ, যেমনটা চেয়েছিলেন তিনি।চারিদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া! কাচের জানালায় চোখ রাখলে দূরের কোনো গলিতে দেখা যায় মৃত মানুষের কঙ্কাল।খাবার জলের হিসেব করা হয় পাঁচশোর নোটে। বৃষ্টি শুধুই কোনো এককালে বইতে পড়া একটা শব্দমাত্র।যোদ্ধার মতো কাটে প্রতিটি দিন। খাবারের জন্য রীতিমতো লড়াই চলে!সবাই আবার হাত মিলিয়েছে প্রাচীনের সাথে। তবে অফিসের সেই একফালি জমিতে পাইনের গাছটা আজও টিকে আছে।আজও সেখানে বৃষ্টি আসে, ফুল ফোটে! সেখানে আজও পাখিদের কলরব শোনা যায়। অসুস্থ মানুষগুলো এসে বসে গাছের ছায়ায়, দু’চোখ ভরে সবুজ দেখে তারা। আমিও যাই রাতের বেলা। জড়িয়ে ধরি পাইনের দেহ। মনে হয় সেই দাদু যেন বেঁচে আছেন গাছের প্রতিটি পাতায়! মিনিট দুয়েক পরে যখন ডুবে যাই আগামীর চিন্তায়, গাছের একখানা পাতা গায়ে এসে পড়ে; বাতাসে বাতাসে কে যেন বলে যায়-
-“…ভয় নেই,আমি আছি তো…!”