মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩৯ অপরাহ্ন

এই সময় এবং কবির ভেতর ঘরের কথা-রনিতা নাথ

এই সময় এবং কবির ভেতর ঘরের কথা-রনিতা নাথ

এই সময় এবং কবির ভেতর ঘরের কথা
রনিতা নাথ

কাজের গতি বিচিত্র। বিচিত্রতার মাঝে ভালোবেসে কাজ করার আনন্দটাই আলাদা। মানুষ ভেতর ঘরে এক অন্তহীন টান অনুভব করেন প্রত্যহ। সৃষ্টিকে ভালোবেসে সৃষ্টির কোণায় কোণায় অবাধে বিচরণ করেন যাঁরা, তারাই গেয়ে ওঠেন– ‘এ পথ যদি না শেষ হয়/তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’। সকল পরিস্থিতিতে সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টির মাঝে সুখ খোঁজেন।
মানুষের যাপন যখন হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, মান- অভিমান ইত্যাদিতে তছনছ হয়ে যায়, তখন অসময়ে ডাক আসে মৃত্যুর। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা মানুষকে মৃত্যুলোকের দরজায় দাঁড় করিয়ে বলতে থাকে জাত- পাত- ধর্মের উর্দ্ধে উঠে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
ভুপেন হাজারিকা গান– ‘মানুষ মানুষের জন্য/
জীবন জীবনের জন্য’।
এই গানই জীবনের গান। এই গান মানুষের গান। মানুষ থাকলেই সব, অন্যথায় সব ফাঁকি।
পৃথিবীর ইতিহাস বলে প্রতি একশ বছর অন্তর পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে প্রবল মহামারী। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে প্রবল মহামারী সারা বিশ্বজুড়ে। গোটা শতাব্দী ধরে দৈনিক যাপন চিত্রে পরিবর্তনের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেলে সভ্যতাও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। জীবনের তোয়াক্কা না করে বেহিসাবি ঢঙে চলতে চলতে জীবনপথ সংকীর্ণ হয়ে আসে। প্রকৃতির হাতছানি তখন মানুষ অবধি পৌঁছায় না। মানুষ ভুলে যায় তার অবস্থান কোথায় ? সে কী করছে ? কেন করছে ? তখনই বিধ্বংসী মহামারী মানুষের সামনে এসে হাজির হয়। প্রতিদিনকার ব্যস্ত চলনকে থামিয়ে দিয়ে বলে যায়–
জীবন কি ? জীবনের সীমানা কতটুকু।
দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার বিশ্বাসকে আচমকা থামিয়ে দিয়ে মৃত্যু এসে কড়া নাড়ে। কপাট খুললেই মৃত্যুর তান্ডব দেখে মানুষ স্বচক্ষে। এরকম এক পরিস্থিতিতে সারা দেশব্যাপী মানুষ যখন বন্দিদশায়, তখন উত্তরপূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্য ত্রিপুরার কবিগণ বিভিন্ন প্রান্তে বসে কবিতা যাপনে তুলে আনছেন– বন্দিদশার কথা, রাষ্ট্রের কথা, মানুষের কথা, ভালোবাসার কথা, মাটির কথা, জীবনের কথা।
কবি ও লোকগবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন সময়ের কথা বলতে গিয়ে তরতাজা লাশের গন্ধ পেয়েও তিনি বলেছেন মৃত্যু ঝড়ের পরে আবার মানুষ জেগে উঠবে, আবার মানুষ নতুন সূর্যোদয় দেখবে, মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, সেই ভালোবাসায় ভরে যাবে পৃথিবী। কবির ভাষায়–
”মানুষ মানুষ মানুষ আজ অসহায় বন্দীর মত ছটফট করে, আর ইতিহাসের দিকে তাকায়। এমন বহু বহু মারণঝড়ের পর জেগে উঠেছে আবার মানুষ। দৃঢ়তায় সূর্য উঠবে। মানুষের নামে। আবার নতুন করে ভালোবাসায় ভরে যাবে বিশ্ব।” _ (খোল দ্বার, অশোকানন্দ রায়বর্ধন)
হতাশার মাঝেও এক দৃঢ় আশার আলো কবি দেখতে পেয়েছেন মানুষের জন্য। মানুষ আবার স্বাভাবিক ভাবেই বাঁচাবে মধুময় পৃথিবীতে।
কবি সেলিম মুস্তাফা বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও মুক্তির আনন্দে ক্লান্তিহীন হেঁটে যাবার কথাই বলেছেন কবিতায়–
“পা দুটো অক্লান্ত, মুক্তির আনন্দে ছন্দ হারায়নি মোটেই
. . . . . . . . . . . . . . .
সূর্য নেমে গেলেও, রাতের
শাখা প্রশাখার ফাঁকে উঠে আসে চাঁদ।
আমরা হাঁটব, হাঁটব
থামব না কখনোই।”(করোনার দিন/১, সেলিম মুস্তাফা)
মানুষের কাছে এক দৃঢ় প্রত্যাশা, জীবন বন্দিদশায় থেমে থাকবে না। সকল মোকাবিলার শেষে আকাশে চাঁদ। সূর্যের ন্যায় মানুষ মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে মৃত্যুকে জয় করে পুনরায় হেঁটে যাবে জীবনের গলিপথে।
কবি পদ্মশ্রী মজুমদার কবিতা জগতে এই সময় এবং কবির ভেতর ঘরের অন্যতম মুখ।ভাবনার গভীরতা এতো অতলস্পর্শী
যেন এক ডহর লাগা ঘোর। সাধারণ যাপনে ব্যস্ততার মাঝেও কবি সময়ের দর্পণে চোখ রাখেন। মানবিক আর্তি কবির কবিতায় সর্বদাই পরিলক্ষিত। বর্তমান পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে কবি এক আশ্চর্য অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন বিশ্বের প্রেক্ষাপটে –
“পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্ক
চলে যাচ্ছে এক অদ্ভূত
কোয়ারান্টাইনে। “
-পদ্মশ্রী মজুমদার।
সংসারে থেকেও চেনা গন্ডীর বাইরে মানুষের পদক্ষেপ দ্রুত এগুচ্ছে। গভীর আত্মবিশ্লেষণে কবি বলেছেন–
“সবকিছু ছুঁয়েই আছি
সংসার, সন্তান —–
শুধু ছুঁতে পারিনি নিজেকে
চেনা গন্ডীর বাইরে
এক অচেনা আমি
আশ্চর্য কোয়ারান্টাইন! “
-পদ্মশ্রী মজুমদার।
কবির ব্যক্তি ভাবনার স্তর ভেদকরে বলা যায়, সব সম্পর্কের মাঝে যেন তৈরী হচ্ছে এক আশ্চর্য কোয়ারান্টাইন।সংসারে থেকেও দূরত্বের ব্যবধানে এগিয়ে চলছে হাজার হাজার মানুষ কোন এক অন্ধকারের অভিমুখে।
বন্দিদশাতে ও যে ঘরের বাইরে পা রাখতে হয় খাবারের সন্ধানে।সময়ের সাথে লড়াইয়ে কবি অপাংশু দেবনাথ সেই বাস্তবকে রূপ দিয়েছেন কবিতায়
“ফটক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ি,
শষ্যশূন্য হয় প্রতিদিন মানুষের হাড়ি। “
(তবু বিশ্বাস ,অপাংশু দেবনাথ)
প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবনগতি একি তালে আবর্তিত। মানুষের জীবনে বিপর্যয় ঘনিয়ে আসলে প্রকৃতি ও ধ্বংস হয়। প্রকৃতি অপরূপ ডালি নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের অপেক্ষায়। মানুষ ও প্রকৃতির মেলবন্ধনেই পৃথিবী সুন্দর। তাই পৃথিবীর অসুখ মানেই লক্ষ একটাই প্রকৃতি ও মানুষ নির্মল ও সুস্থ থাকা। কবির ভাষায় —
“এক আকাশ, এক হাওয়া,এক সূর্য,একই আলো অন্ধকার।
একই লক্ষ্য মানুষের বেঁচে থাকার, পৃথিবীর অসুখ সারিয়ে তোলার। “
-(লকডাউন,অপাংশু দেবনাথ)
কবি গোবিন্দ ধর অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষের চলনের দিকে তাকিয়ে অনিকেত ভালোবাসার কথাই বলেছেন। ভালোবাসাই পারে সবকিছুকে জয় করতে। কবির ভাষায়–
“আসলে মানুষ তো মৃত্যুর নিকটে গিয়েও
একটি হাতই চায়।
একটু অনুভূতি আর অনিকেত ভালোবাসা”
-(করোনার দিনগুলোতে প্রেম, গোবিন্দ ধর)
ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে কবি নিরাশ হয়েছেন বারবার। মানুষ আজ বড় ক্লান্ত। একাকী। গভীর খাদের সামনে হাজার হাজার মানুষের পা। সামনেই মৃত্যু হা করে তাকিয়ে আছে মানুষের দিকে।
“মানুষ বড় ক্লান্ত মানুষ বড় একাকী
মানুষ জরাগ্রস্ত গভীর খাদের নিকট।”
-(ভালোবাসা নিয়ে এসো, গোবিন্দ ধর)
কবি হতাশার মাঝেও আলোর পথ দেখাতে গিয়ে বলেছেন–
“এ সময় পরস্পর থেকে পরস্পর একটু দূরে
হাত ধরে পিঠে পিঠ রেখে
নিঃশ্বাস নেই অসুখের অপরপাঠ।
নিরাময় হোক অন্ধকার। “
-(ভালোবাসা নিয়ে এসো, গোবিন্দ ধর)
অন্ধকার নিরাময় হলে হয়তো মানুষ মানুষের জন্য হাঁটবে কিছুটা পথ প্রকৃতির সান্নিধ্যে। জন্মের পর থেকেই মানুষ জীবন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। স্বাভাবিক ভাবে মনে হয় দৌড় জীবন’কে পারিপার্শ্বিক অবস্থার দোলনে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু কবি সঞ্জীব দে দৌড়কে জীবনের আঙ্গিকে উপস্থাপন না করে একেবারেই ভিন্ন মাত্রায় মৃত্যুর মাঝে উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন মানুষের ঢল দৌড়ে সামিল মৃত্যু উৎসবের আয়োজনে। কবির ভাবনায়-
“নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি যে আকাশে।
পতঙ্গের মতো আমরা প্রতিনিয়ত আগুণের
লেলিহান শিখার দিকে ছুটে যাচ্ছি। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই।
জ্বলেপুড়ে ছাই হবো জেনেও
সেই মিছিলেই গাদাগাদা করে ছুটছি।
দৌড় -দৌড়-দৌড়! এই দৌড়-
মৃত্যুর উৎসব রচনার অনির্বচনীয় দৌড়। “
-( মৃত্যুর ঢাল,সঞ্জীব দে)
মানুষ যেন মৃত্যুর আয়োজনে সামিল হতে চাইছে বার বার। তাই পরষ্পরের কাছাকাছি থেকেও দম বন্ধ হয়ে আসছে চার দেয়ালের ভেতর। পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ। মানুষ মানুষকে দেখে ভয় পাচ্ছে। জন্তু জানোয়ারকে নয়। বাঁচার তাগিদে আতঙ্কে দূরত্ব বজায় রাখতে সাবধানতা অবলম্বন করেছে প্রতিনিয়ত। কবির ভাষায় –
“মানুষকে দেখে মানুষ দূরে সরছে
দূরে বহু দূরে।
আর কতদূরে গেলে মানুষ মানুষের কাছে আসবে।
মুক্ত আকাশে বিহঙ্গ ডানা মেলে উড়বে! “
-(প্রতীক্ষার দীর্ঘলাইন, সঞ্জীব দে)
কবি সময়ে হতাশ হলেও জীবনের মূল সুর কোথায় লুকিয়ে আছে সেই সত্যকে চাপা রাখেন নি। বিজ্ঞান নির্ভর জীবনে বিজ্ঞানের জয় অবশ্যম্ভাবী। বিজ্ঞানই পারবে জীবনের ছন্দকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে। কবির ভাষায় তা স্পষ্ট –
“সব পরীক্ষার শেষে
বিজ্ঞান জয়ী হয়। পৃথিবীর সবুজায়নে
ভরে উঠে বার বার।
. . . . . . . .
খুব শীঘ্রই বেজে উঠবে জীবনের সুর। “
-(প্রতীক্ষার দীর্ঘলাইন,সঞ্জীব দে)
রাতের অবসান একটি ভোর আলোর বার্তা নিয়ে আসলেও অসময়ের ভোর ঢেকে থাকে রাতের অন্ধকারে। সুসময়ের আলোর জন্য তবুও মানুষ ভোরের প্রতীক্ষায় রাত কাটায়।কবি অভীককুমার দে আলোর প্রত্যাশায় আসন্ন গভীর অন্ধকারের মাঝেও এগিয়ে যাবার কথাই বলেছেন কবিতায়-
“ভোরের চোখেও রাতের কাজল কালি, তবুও
আলোর জন্যই এগুতে হয় ভোরের অভিমুখে। “
-(অভিমুখ, অভীককুমার দে)
দৃশ্য থেকে অদৃশ্যের ভেতর যে সত্য নিহীত। তা সামনে আসলেই মানুষ বাস্তবকে হজম করতে পারে না।কঠিন হয়ে উঠে জীবনচক্র।এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি আজ গোটা বিশ্ব।মানুষ নিজস্ব রাজ্যপাঠ খুলে এতোই ব্যস্ততায় যাপন করে দিন রাত। যেখানে মুহুর্তের জন্য মানুষের স্মরণে আসে না জীবনদীপ নিভে যেতে পারে নিজের তৈরি ধ্বংসের উপকরণের মাঝেই। কবির ভাষায়-
“সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব বলে ঢোল পেটানো
প্রাণীরা বোঝে না——-
সৃষ্টিতে কিছুই দিতে পারে নি সে
ধ্বংসের উপকরণ যতকিছু,তার
পৃথিবীর জন্য উপকারী নয়।
এই সত্য শূন্যচোখের আয়নায় এবং
ভুলে যায়—শূন্য থেকেও বিয়োগ হতে পারে। “
-(শূন্যচোখের আয়না, অভীককুমার দে)
বেসামাল পরিস্থিতিতে কবি এগিয়ে চলার কথা বলতে গিয়ে নিজ স্বরূপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কবিতায়।তেমনি ফুটপাতে যাপনকারী মানুষের জীবনে ঘনিয়ে আশা নিরাশার ছাপ দেখতে পেয়ে কবি বললেন—
“গৃহহীন মানুষ ঘরবন্দী হতে পারে না।
কাল্পনিক বাসা থেকে বেরিয়ে ঝড়ের কবলে পাখি জানে না, সব হারিয়ে অন্ধকারের দিকে পথ।
. . . . . . . . . .
মৃত্যু বিতরণ করছে বাতাস। “

(এই পথেই আলো আসবে, অভীককুমার দে)
মৃত্যুর ভয়ে যখন কাঁপছে সারা দেশ।তখনো যাযাবর খাবারের অন্বেষণে পথে নামায় ভিড় –
“মৃত্যু বলছে-
ঘরের ভেতর ঘর খোঁজে ওরা
যাযাবর জানে খাবারের জন্য রোজ মহামারী। “
-(শেষ যাত্রার আগে,অভীককুমার দে)।
ত্রিপুরার কবি ও ছড়াকার অমলকান্তি চন্দ
ছড়ার ছন্দে সময়ের দোলনকে তালে তালে তাল
মিলিয়ে বেশ সুন্দর উপস্থাপনায় জীবন রহস্যকে ছড়ার পাতায় নিয়ে এসেছেন।যার মধ্যে সমান্তরাল গতিতে নিহীত হচ্ছে জীবনের ছন্দপতনের ইতিহাস।ছড়াকারের বাক্ নিপুণতায় স্পষ্ট যাপন চিত্র-
“করোনা বাড়ি যাও খেটে খাই দিনভর,
পায়ে পায়ে হেঁটে তুমি কেন ঘুর তিন ঘর?
ভয়ে সব জড়োসড়ো তিনহাত দূরে তাই,
কাছে ডেকে কোলে নাও এত প্রেম কেন ভাই?
হাঁচি তুমি ভালোবাসো, কাশিতে বাজিমাত,
শ্বাস ধরে টান দিলে আমি বাপু কোপোকাৎ।”
– (ইউ কে,অমলকান্তি চন্দ)
ক্ষুধার্ত মানুষের কথা বলতে গিয়ে ছড়া নির্মাণের দক্ষতায় এক সুন্দর চিত্রকল্প ভেসে উঠে ছড়ার শরীরে।সেই চিত্রের মাঝে গোটা বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না প্রতিবাদের ঝড় তোলে-
“ক্ষুধার্ত দেবতা মিছিলের পথে শূন্য থালা হাতে
অমন খেলা খেলবে কত রাজা, দেবতার সাথে। “
– (বিগুরাই হালামের বাড়ি, অমলকান্তি চন্দ)
পৃথিবীর অসুখ মানুষের পায়ে পায়ে। একটি পা এগিয়ে আসলেই জড়িয়ে ধরবে অপরকে। তাই দূরত্ব বজায় রেখেই এগিয়ে চলা নিজের ও অপরের স্বার্থে। রোগের কথা বলতে গিয়ে ছড়াকার খুব সুন্দর ছন্দ কেটেছেন।যেখানে অলংকারশাস্ত্র ও ছন্দের একত্র মিলনে অপূর্ব ঝংকার শুনা যায় ছড়া পাঠে—
“পাড়ার মোড়ে দিলুর দাদু
বলছে ডেকে রোগা কিরে?
ছড়ায় শুনি একেক করে
গেলেই বুঝি লোকের ভীড়ে।
. . . . . . . . . . . .
দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে দিলু
বলল দাদু শুনছ ঠিক
ঐ করোনা বিশ্ব জুড়ে,
কাঁপছে দেখ চর্তুদিক।
ভাইরাসটা দাঁত দেখিয়ে
প্রাণগুলোতো নিচ্ছে কেড়ে,
এখন তারা আমার দেশে
দিনকে দিন যাচ্ছে বেড়ে। “
-(রোগটা কিরে,অমলকান্তি চন্দ)।
ছড়া সাহিত্যে চোখ রাখলেই ভাবীকাল জানবে পৃথিবী ও মানুষের কথা।ত্রিপুরার আরো একজন কবি শচী চৌধুরী বেশ সুন্দর ছড়ার ছন্দে সময়কে এঁকেছেন —
“বন্ধ চোখে আলোর হদিশ
অন্ধকারে আঁকা
কুড়িয়ে নাও ঝলকখানি
গুপ্ত হয়ে থাকা”
অথবা,
“করোনাকে করি না ভয়,
সখ্যে ফিরতেই জানি,সঙ্গীহীন হতে হয়। “
কবি বাস্তবকে মেনে নিয়ে পুনরায় শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশায় সঙ্গীহীন হাঁটার কথাই বলেছেন।যেখানে বিশ্বের এই করুণ অবস্থা সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে,
সময় জ্ঞানহীন মানুষের চলনের গতি দেখতে পেয়ে কবি ও প্রতিবাদী হন।নিজে ভালো থাকার
পাশাপাশি সমাজ ও দেশের মঙ্গলার্থে যে বন্দিদশার ডাক দিয়েছে বিশ্ব ।সেই অবস্থানে থেকেও রাস্তায় মানুষের ভীড় দেখে কবি রাজীব
মজুমদার প্রতিবাদের ভাষায় বলেন-
“একটু ধৈর্য ধরুন।সেই সুযোগ আসছে।
আপনিও মৃতদেহ শুকোতে দেবেন
আপনার দশের ,আপনার নিজের
ডট ডট ডট
যেমনটি দেখছেন ইহ ভিটেমাটির বুকে
সাজানো অন্ধ চোখে মৃতের সুখ দেহ। “
– (যারা কান্না শুনে না,রাজীব মজুমদার)
ত্রিপুরার তরুণ কবিদের সারিতে জয় দেবনাথ অতি সন্তর্পণে নিজ অবস্থান তৈরী করে নিচ্ছেন। এই সময়কে ধরতে পেরেছেন কবিতার আঙ্গিকে ।কবির শব্দ প্রয়োগের কৌশলটা ভিন্নমাত্রিক। কবি প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট ঘটনাকে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করে চলেছেন কবিতায়।এই সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষের দিকে তাকিয়ে কবি বলেছেন-
“শুধুমাত্র প্রত্যাশার দৌড়ে
কোনো অন্ধকার সকালে—
নাকবাঁধা মানুষেরা থলি হাতে বাঁচার জন্য
ভীড় জমাতে গিয়ে মরে যায়। “
– (কোয়ারান্টাইন ,জয় দেবনাথ।)
মানুষ যখন মৃত্যু ভাবনায় শায়িত তাজা লাশের উপর।তখন দিকভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেই সময় মনের জোরটাই চলার একমাত্র অবলম্বন।সময়ের ঝড় থেমে গেলে প্রকৃতি আবার নতুনরূপে সাজবে সেই ভাবনায় কবি দেবাশিষ চৌধুরী বলেছেন-
“মানুষ মরে গেলে কাঁদবে, সময় চোখের জল মুছে দেবে, লাশ আর ছাঁই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেদিন আমি তুমি কেউ থাকবো না, আমাদের দেহ, রঙ, খেলা সব শেষ হয়ে যাবে। এই পরিচ্ছন্ন গ্রাম জুড়ে থাকবে শুধু ধোয়া আর লাশের গন্ধ! পরিচালক পাখির দল ঝাঁক বেঁধে আসবে নানা ঋতুর নানা স্বাদে পরিপূর্ণতা পাবে তাঁদের স্বর্গীয় সঙ্গম! “
-(দেবাশিস চৌধুরী)
কবি সৌমেন চক্রবর্তী অনেকটাই স্বকীয়তা নিয়ে কবিতার জগতে পাড়ি দিচ্ছেন কবিতাকে ভালোবেসে। আত্মদহনের শব্দগুলোকে নিরন্তর গুছিয়ে নিচ্ছেন কবিতার মুক্ত আকাশে। বর্তমান মানুষ ও রাষ্ট্রের কথা কবিতার ছোট্ট পরিসরে তুলে এনেছেন সাবলীল ভাষায়-
“মানুষ যে যার রঙ নিয়ে ভাগ হয়ে গেলে
এই ঘরে আর অন্ধকার ছাড়া তেমন কাউকে দেখা যায় না,
ভেতরে একটা কুপি নিজের প্রচেষ্টায় জ্বলে উঠতে চাইছে…
নিভিয়ে দেওয়ার হাতগুলো প্রস্তুত আছে আগে থেকেই-
ঘরের কোণায় পাশা খেলছে শকুনি। “
– (প্রতিবিম্ব ,সৌমেন চক্রবর্তী)
বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ঠোঁটের কোণে হাসি ছাড়া আর কিছু নেই।এই ভাবনায় কবি বলেছেন–
“হাসি মুখ ছাড়া আর কোন প্রতিরোধ নেই এখন
নিজেকে গিলে জাবরকাটা ছাড়া কোনো নতুন রাস্তা নেই। “
-(ঘোড়া,সৌমেন চক্রবর্তী) ।
উপরোক্ত কবিতা আলোচনায় বর্তমান মানুষ, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।সাহিত্য এইভাবেই সময়কে ধরে রাখে। সময়ের ঘোর অন্ধকারে সভ্যতা এগিয়ে গেলেও কোন কিছুই স্থির থাকে না। পৃথিবী আজ মানুষের জীবনে ঘনিয়ে আসা বিপর্যয়ের পাশে নীরবতা পালন করছে।শোক পালন করছে। ধ্বংসের মাঝে সৃষ্টির উৎস নিহীত থাকে। হয়তো আজ নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় রাতের অবসান হচ্ছে না। কিন্তু অপেক্ষার অবসান হবেই। সমস্ত বিপদ কাটিয়ে অদূরেই পৃথিবীর শান্তি ফিরে আসবে। সেইদিন আবার সকল দূরত্ব কাটিয়ে মানুষ মানুষের পাশে যাবে অবাধে। একি পথে, ঘাটে, হাটে, বাজারে, সমাগম হবে মানুষের।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge