আশাফা সেলিমের ‘সস্তা কথা’: ব্যতিক্রমধর্মী ছড়ার বই
আবিদ করিম মুন্না
বরেণ্য কথাকার আবু হেনা মোস্তফা কামালের জনপ্রিয় একটা গান আছে-‘অনেক বৃষ্টি ঝরে, তুমি এলে/ যেন এক মুঠো রোদ্দুর, আমার দুচোখ ভরে/ তুমি এলে…।’ আশাফা সেলিমের প্রথম বইটি, আজ বরষার দিনে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রিয় সেই গানটিকে। শেষ পর্যন্ত ভক্ত পাঠকদের বহুদিনের জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে ‘সস্তা কথা’ মলাটবন্দি হয়ে বাজারে এসেছে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে, ভিন্নস্বাদের ৫২টি ছড়া নিয়ে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইটি প্রকাশ করেছে ভিন্নকোণ প্রকাশন, রংপুর। প্রায় নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এই ছড়াকারের
ছড়া যারা বিভিন্ন সময়ে পড়েছেন কিংবা ‘সস্তা কথা’ পড়েছেন, নিশ্চয়ই-নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন আশাফা সেলিম একজন উঁচুমানের ছড়াকার। প্রায় ৩ দশক ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দৈনিকগুলোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে চলেছেন। কিন্তু বই প্রকাশের তাগিদ অনুভব করেননি। তার এই বৈশিষ্ট্য তাকে ছড়াকার হিসেবে লেখক সমাজে ‘বিশিষ্ট’ পরিচয় দান করেছে।
‘সস্তা কথা’র কভার ডিজাইন করেছেন সাফিন চৌধুরী। প্রচ্ছদ এবং ফ্ল্যাপে ব্যবহৃত ছড়াকারের ছবি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমানের তোলা। প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে বস্তা কাঁধে একজন ফেরিওয়ালা। গভীরভাবে এই ছবিটি দেখলে প্রশ্ন জাগতে পারে-কে এই ফেরিওয়ালা? সেটা কি কেবলই একজন হকার, এক বস্তা বই ফেরি করছেন, নাকি ছড়াকার নিজেই বস্তাবোঝাই ছড়া কাঁধে নিয়ে…? কে জানে।
চারদিকে ৭ ইঞ্চি মাপের (বর্গাকারের) কোনো সিরিয়াস বই সাধারণত চোখে পড়ে না। বইটির অনন্য সংযোজন অতিদীর্ঘ আত্মকথন বা কৃতজ্ঞতাপত্র; যা আমাদের সাহিত্যজগতে ইতোপূর্বে চোখে পড়েনি। কৃতজ্ঞতাও যে এত শিল্পিতভাবে প্রকাশ করা যায়, তা এই ১০ পৃষ্ঠা পড়লে বোঝা যাবে। শুরুতে ১০ পৃষ্ঠাকে অনেক ভারি মনে হলেও, মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলে, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। এখানে বেশ কিছু গুণী মানুষের কথা লিখেছেন, যারা ছিলেন তার ছড়া লেখার প্রেরণা। পরিচয়সূত্রে, তাদের অনেকেই আমারও শ্রদ্ধেয়। প্রয়াত: ছান্দসিক কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ, সাংবাদিক এম আয়েনুজ্জামান, চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন, সাংবাদিক নোয়াজেস খোকা, নদী গবেষক ও সাংবাদিক আব্দুস সাত্তার, নাট্যজন এজেডএম নাসিমুজ্জামান পান্না, সাংবাদিক শেখ কল্লোল আহমেদ প্রমুখ। বইটি পড়তে গিয়ে, খুব মনে পড়ছে প্রয়াত ছড়াকার ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল হাসনাত লাবলুকেও। এই মানুষগুলো আজ বেঁচে থাকলে এবং এই ছড়ার বইটি হাতে পেলে নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হতেন।
‘সস্তা কথা’র উৎসর্গপত্রটিও ভিন্ন ধরনের- ‘আমার আদর্শ পাঁচ ‘ম’-মা, মাদার তেরেসা, মোনাজাতউদ্দিন, মোঃ আফজাল এবং মুকুল মোস্তাফিজ।’ এই বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে জননেতা মোঃ আফজাল এখনও আমাদের মাঝে আছেন।
ব্যতিক্রমী বেশকিছু লেখা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত মানুষের যন্ত্রণা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি, বাংলা ভাষা, যুদ্ধাপরাধ, নিত্য সমস্যা, দুর্নীতি, দেশপ্রেম, রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন, বেকারত্ব, জাতীয় দুর্ভোগ, দ্রব্যমূল্য, ঘুস, বৈষম্য নানা বিষয় ফুটে উঠেছে সেলিমের ছন্দে। তবে, বইটি তথা লেখাগুলো নিয়ে গবেষণা, পর্যালোচনা ও ধারাবাহিক চর্চা হলে নতুন অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। এত নিঃশঙ্ক এবং সাবলীল ভাষায় রাজনৈতিক বা সমাজনৈতিক ছড়া সাধারণত চোখে পড়ে না। কদাচিৎ যদিও পড়ে সেগুলোর মাত্রা, তাল, লয় ও ছন্দ মেলাতে গিয়ে অনেক সময় ছড়াকার খেই হারিয়ে ফেলেন এবং সেসব ছড়া ততটা মানোত্তীর্ণ হয় না।
আশাফা সেলিমের ছড়ায় শক্তি বা সাহস যেমন লক্ষ্যণীয়, তেমনি ফুটে উঠেছে বিনয়। যেমন, সাহসের উদাহরণস্বরূপ তার ‘রাজাকার নিধন প্রক্রিয়া’ ছড়াটি, আর ‘ছড়া আমার হয় না’ বিনয়ের উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে। বইটিতে শিশুদের নিয়ে কোনো ছড়া স্থান পায়নি। ফলে, আপাত অসম্পূর্ণ মনে হলেও, ‘কেমন করে লেখি’ ছড়াপাঠে সেই ধারণা পাল্টে যেতে বাধ্য। কেন তিনি শিশুতোষ ছড়া লেখেন না? তার উত্তরে লিখেছেন-‘…শিশুর জন্যে মিষ্টি ছড়া/যায় কি লেখা আর/লাল-সবুজের ফ্ল্যাগ যদি পায়/শীর্ষ রাজাকার?…(ছড়া : কেমন করে লেখি)’। কিন্তু, নিরেট শিশুতোষ ছড়া লিখলেও যে তিনি ভালোই লিখবেন, তার প্রমাণ রেখেছেন একই ছড়ায়-‘…কেম্নে লেখি চাঁদের ঝিলিক/তারার দেশে গিয়ে/সূর্যমামার মেয়ের সাথে/সাদা মেঘের বিয়ে…’। ‘মায়ের জন্য এপিটাফ’ ছড়াটি বহু পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। ভালো লাগবে বিখ্যাত কয়েকজন মানুষকে নিয়ে নিবেদিত ছড়াগুলোও।
কালোর বদলে গাঢ় চকলেট রঙের বর্ণ ফুটে উঠেছে হাল্কা ক্রিম রঙের ছাপ দেয়া কাগজে। কোনো কোনো পৃষ্ঠায় জলছাপ আলপনা। ঝকঝকে মুদ্রণের ‘সস্তা কথা’ বইটি পাওয়া যাচ্ছে ঢাকায় : শাহবাগে, পাঠক সমাবেশ সেন্টার, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর (দোতলায়), এবং রংপুরে : লাইব্রেরি এলাকায়- টাউন স্টোর্স ও ইস্টবেঙ্গল লাইব্রেরি, লালবাগ মোড়ে বইতরঙ্গ লাইব্রেরি এবং জররেজ মার্কেটে বেলা বই ঘরে। ৭২ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৬০ টাকা।
আবিদ করিম মুন্না : সহকারী সম্পাদক, ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা