আল-আমীন আপেল এর গল্প আষাঢ়সুখ
এক.
আষাঢ়ের শেষাশেষি। ভরা আষাঢ় সীমাদের পদ্মপুকুরে, বাবুদের তালপুকুরে। সবখানেই আষাঢ়ের তীব্র উপস্থিতি। পোয়াতি মেঘেদের প্রবল বৃষ্টিপাত-উৎসব চলছে মহাসমারোহে। আষাঢ় নেমেছে ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন সৌম্যদেহী যুবক রিয়াদের মনেও। ভোর থেকে মনটা ভার ভার উচ্চ-মধ্যবিত্ত বক্ষদেশ সমন্বিত মাহিয়ার জন্য, মুঠোফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে।
প্রথমে রিয়াদ ভাবল: পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু, খানিক বাদে মনে হলো পরীক্ষার পালা নিদেনপক্ষে তিনদিন আগেই শেষ হয়েছে। ব্যাপারটা মোটেও চিন্তামুক্ত থাকতে দিচ্ছে না। কেমন কেমন ঠেকছে রিয়াদের কাছে, মনের আকাশে শংকার কালো মেঘ ঘন হচ্ছে যেন!
বিষ্টিতে বিষ্টিতে সকাল হয়েছে অনেক আগে। কি করা যায়? কি করা যায়?- প্রশ্নরা যেন কাঠঠোকরার মতন ঠুকে যাচ্ছে হৃদবৃক্ষে! উপায় একটা আছে। সেটাকেই কাজে লাগাবে কি? ভাবছে রিয়াদ। বাসায় গায়ে রেইনকোর্টে, মাথার উপর একটা নীলরঙা ছাতা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো রিয়াদ। পথের ধারে সোনালু গাছটায় যৌবন পেয়েছে। থোকা থোকা হলদে ফুলে ভরেছে গাছটি। একছড়া সোনালু তুলে নেবে নাকি মাহিয়ার জন্যে? ভীষণ পছন্দের ফুল ওর। ভিজে খানিকটা নাজেহাল হয়ে গেছে ফুলেরা। তবুও তুলে নিল একছড়া।
এই এলাকার নাম কানুনগোটলা। সংস্কৃতি পণ্ডিত প্রকাশচন্দ্র চৌধুরীর বাড়ির দক্ষিণে ১৮৯০ সালের তৈরী ডিমলা কালী মন্দির। সেটিও এ বৃষ্টিতে স্নান করছে। মন্দিরের চূড়ায় অবস্থানরত কবুতরগুলি বৃষ্টিবিলাস করছে, আয়েশ করে।
জে.বি সেন রোড ধরে হাঁটার পালা শুরু। বৃষ্টির জন্যে আস্তে আস্তেই হাঁটছে রিয়াদ। কয়েক পা এগিয়ে দেখা হলো রিপনের সাথে। রিপন কেরকাটার ধর্ম খ্রিষ্টান। তবে বন্ধুত্বে ওসব খাটে না, বন্ধুত্ব সম্পর্কটা একটা আলাদা অনুভূতি, আবেগের নামান্তর। বন্ধু তো সেই- অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যাকে নির্বিঘ্নে, নিচিন্তে ভালোবাসা যায়; হৃদয়ের বিশ্বাস নামের ঘরটাতে যাকে আত্মীয় করে রাখা যায় জন্ম-জন্মান্তরের জন্যে। রিপন আর রিয়াদে বেশ দোস্তি। আপদে-বিপদে ওকেই পাশে পাওয়া যায়। বাকিসব স্বার্থপরদের শ্রেণীভুক্ত।
মাস তিনেক পরে দেখা হলো আজ, দুজনের। এতে রিয়াদের খুশিতে উল্লাসিত হওয়াটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু, হলো ঠিক উল্টো। কারণ, মাহিয়ার কড়া নিষেধ; তার চোখে রিপনের স্বভাব মোটেও ভালো লাগে না। সে যাই হোক, বন্ধুর সামনে পরে এড়িয়ে যাওয়া বোধকরি একদমই সমীচীন হতে পারে না; তাই পা দুটোকে থেমে যেতে নির্দেশ দেয় রিয়াদ।
-আছিস কেমন রিপন?
-আছি এক রকম। বাদলার দিনে আর ভালো! কাজে যেতে পাচ্ছি না। থাক সে কথা। তুই কেমন আছিস?
-আছি রে, মনটা তেমন ভালো নাই।
-হুম, জানি তো। মিস মাহিয়া তো ওসমানের সাথে ভেগেছে পরশু ভোর রাতে।
– তাই নাকি? দেখেছিস তুই?
-না, সেলিমের কাছে শুনলাম।
-নিজ চোখে তো আর দেখিস নি। ব্যাটা কবি একটা ফাউল, তুই তারচে’ বড় ফাউল!! মাহিয়া ঠিক-ই বলে তোরা নিচু মনের মানুষ। তোদের মন মানসিকতা এমন কেন?
-তুই থাম। অনেক বলছিস। আমি ভুল শুনতে পারি। কিন্তু, সেলিম তো আর ভুল দেখে নি। বিশ্বাস না হলে নিজে গিয়ে দেখে আয়। মাহিয়া বাড়ি নেই। যা দেখ!
-ভাগ তুই!
কিছুই অনুভব হচ্ছে না রিপনের কথায়। এটা যে ওর ফাজলামি সে ভালো করেই জানে রিয়াদ।
বৃষ্টিপাতের গতি যেন হঠাতেই বেড়ে গেল। রিয়াদকে এমনি এক প্রখর বৃষ্টিমুখর আষাঢ়দুপুরে একরাশ বেলীফুল দিয়ে প্রপোজ করেছিল মাহিয়া। যদিও সচরাচর ছেলেদের পক্ষ থেকেই মেয়েদের প্রেমপ্রস্তাব নিবেদন করা হয়, তবে উল্টোটাও হয় কখনো-সখনো।
মাহিগঞ্জ কলেজে রিয়াদ তখন প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ে। বর্ষা উপলক্ষে কলেজ থেকে একটা দেয়ালিকা বের করা হলো। সেখানে রিয়াদের একটা কবিতা ছাপা হয়েছে। সেই কবিতার প্রেমে পড়ে রিয়াদে পাগল হয়, মাহিয়া।
-তোমার কবিতার উৎস হতে চাই..
বলেই দুরু-দুরু বক্ষে একটা লালগোলাপ রিয়াদের হাতে ধরিয়ে দিল। রিয়াদ তো রীতিমত অবাক!
অনন্য সুন্দর আর মায়াবী একটা মেয়ে মাহিয়া। ওর সাহসিকতা মুগ্ধ করে রিয়াদকে। কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে থাকে দুজনে, কলেজের দোতালায়। বৃষ্টি বলে বেশি জনই অনুপস্থিত ক্লাশে। বাহিরে তখন ভীষণ রকম আষাঢ়। এদিকে রোমান্টিক মুহূর্ত!
-হুম, বাড়িয়ে দাও তোমার হাত..
-হুম, বাড়িয়ে দিলাম। ছাড়বে না তো কখনো?
-না, তুমি ছাড়তে চাইলেও না।
-ছাড়ব না। ভালোবাসি.. ভালোবাসি..
-ভালোবাসি আমিও।
সেদিন থেকে রিয়াদের বুকের বামপাশের হৃদজমিনটা মাহিয়ার নামে বরাদ্দ। দারুণ রকম ভালোবাসা, ভালো লাগা, ভালো থাকা। উড়াল উড়াল সাতরঙা রঙ্গিলা সময় দুজনের।
মাঝে একবার কি নিয়ে দুজনে খুব মান অভিমান। কথা কওয়া নাই। খোঁজ নেয়া নাই। দুজনেই অশান্তির আগুনে পোড়ে। অনুভূতিগুলোকে পোড়ায়। অনিদ্রায় কাটায় রাত্রি। রুপোলী চাদঁটাও যেন জেনে গেছে ওদের এই মন খারাপের খবর, মুখ গোমড়া করে থাকে; অনেকদিন জোছনা ছড়ায় না চাঁদটা।
বোশেখের পহেলা। সবাই কলেজে এসেছে বাহারি সাজে। পান্তা-ইলিশ আয়োজন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে। মাহিয়া লালরঙা শাড়ি পড়েছে। রিয়াদের ভীষণ প্রিয় লালশাড়ি। তাই হয়তো-বা পড়েছে। সব মান ভেঙে কথা বলল মাহিয়া-ই।
-রিয়াদ, আজকাল কালো-ই পড়া হয় বুঝি?
-হুম, বাহিরে যতটা কালো ভিতরে তারচে’ বেশি। নিকষ কালো। যেখানে আলো পৌঁছায় না।
-মিথ্যে বললে, ইট-পাথরে গড়া এ শহরের মানুষগুলি বেঈমানী করতে পারে। কিন্তু, সূর্যের আলো! এটা কখনোই বেঈমানী করে না। রাতেও তো চাঁদ হয়ে আলো ছড়ায় তামাম পৃথিবীময়। এই যে দেখো, তোমার কালো পাঞ্জাবিটাতেও আলো পড়ছে।
-বাহ! সুন্দর করে কথা বলে শিখে গেছো দেখছি।
-বুঝতে হবে তো কার প্রেমিকা!
–হা, হা।
-হাসি থামাও। কি রকম প্রেমিক তুমি? আমার খোঁজ নিয়েছ এতদিন একবারও?
-আর কালো পড়ো ভালো। তাই বলে আজও পড়বে?
-ভুল হয়ে গেছে। পাল্টে আসছি। তুমি দশ মিনিট অপেক্ষা করো।
বলেই বাইসাইকেলটা নিয়ে ছুটলো। মাহিয়া অবাক! এটা কেমন হলো!
-ঐ পাগল! সাবধানে যাও। আস্তে আস্তে।
রিয়াদ শুধু মুখ ফিরিয়ে একটু হাসল, যে হাসিতে মায়া জড়ানো। মাহিয়া সবার সাথে একটু গল্প করছে। আগে অবশ্য রিয়াদ অন্য ছেলেদের সাথে মাহিয়ার কথা বলাতে রাগ করত খুব, এখন অবশ্য করে না। ‘ওরা তো বন্ধুই’- ওকে এমনি করে বুঝিয়েছে মাহিয়া।
এসো হে বৈশাখ..এসো এসো… গান বেজে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সুসজ্জিত মঞ্চের মাইক থেকে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে ফিরল রিয়াদ। এ আর তেমন দেরি কই? দেশে ‘কিছুক্ষণের মধ্যে ‘ বলে যখন একঘন্টা দেরি করা জায়েজ। তখন এটা কোন দেরিই নয়!
বিশেষ, বিকাশ আর ওসমানের সাথে গল্পসায়রে গল্পস্নানে মেতে উঠেছে ততক্ষণে, মাহিয়া। ওসমানকে সহ্য হয় না রিয়াদের, এই জন্য যে- সব সময় মেয়েদের পিছু নেয়। একটা বিষয় অবাক লাগে রিয়াদের কাছে- ছেলেগুলি সব ওর ডেপার্টমেন্টের, আর মাহিয়া ইতিহাসের ছাত্রী। এত ভাব জমায় কেন ওসমানরা ওর সাথে? ক্যাম্পাসে কি আর মেয়ে নাই! যতসব!
রিয়াদকে দেখে গল্পস্নান অসমাপ্ত রেখে ছুটে এল মাহিয়া। ‘চলো একটা সেল্ফি তুলি।‘ বলে কয়েকটা ক্লিক করলে সে। সেল্ফিবাজি শেষে পান্তাউৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব মিলিয়ে ভালো একটা দিন কাটিয়ে ছিল দুজনে।
আজকাল কেমন জানি হয়ে গেছে মাহিয়া। রসকষ নাই কথায়। কথায় কথায় সাহিত্যচর্চা, ইতিহাসচর্চা নিয়ে খোটা।
–পেয়ারা স্যার, রামকৃষ্ণ সোমানী বাবু, কৃষ্ণারানী দেব্যা- এসব বুড়ো মানুষের সাথে কিসের এত যোগ তোমার? কিসের এত ইতিহাস ঘাটাঘাটি? ইতিহাসে পড়ি আমি, আর গবেষণা করো তুমি? যতসব পাগলামি!
-চুপ যাও। তুমি ঘাটো না বলেই আমি ঘাটি। কারণ, এনারা আমাদের গর্ব। মাহিগঞ্জের গর্ব।
-তুমি থাকো তোমার গর্ব নিয়ে। বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবো। কদিন বাদে মাস্টার্স শেষ। বাবা ছেলে দেখছে।
-তো কি হইছে? দেখুক। সমস্যা কি?
-ও তুমি আমাকে পেতে চাও না সারাজীবনের জন্যে? এ তোমার ভালোবাসা?
–একটা চাকরি বুঝি ভালোবাসার পরিমাপক?
-দার্শনিকতা রাখো। সিরিয়াস হও। তোমার বন্ধু ওসমান চাকরি পেল আর তুমি ঘাস কাটো।
-হা হা। ঘুষ দিয়ে চাকরি আমি করব না ওর মত।
–চাকরি তো চাকরি। এত ভাব নাও কেন?.. তুমি থাকো আমি চললাম।
বলেই রাগ নিয়ে ফিরে গেল মাহিয়া। থামানোর চেষ্টা করল না রিয়াদ। থামালে হিতে বিপরীত হবে। রিয়াদ জীবন নিয়ে ভাবে। ভাবে মাহিয়াকে নিয়েও। রিয়াদ একটু গম্ভীর। তাই সবাইকে সব বলে না, মাহিয়াকেও না।
পরিবারের বড় ছেলে রিয়াদ। মাথার উপর দুটো বোন, বিয়ের বয়স হচ্ছে ওদের। আর ভাইটা বুকের ওপর। মানে একবারে ছোট। বাবা কৃষক। আর মা সংসারশিল্পী, অভাবের সংসারের রাণী। সংসারের আয়ের কাঠিটা তাই রিয়াদের উপরেই। এ কথা কোনোদিন জানতে পারে নি মাহিয়া। তেমন আগ্রহ করে শুনতেও চায় নি। চাইলে হয়তো জানতে পারত। ইচ্ছে করলে মঙ্গলগ্রহের খবরও মানুষ জানে। প্রতি সন্ধ্যা থেকে রাত্তির বারোটা কোথায় থাকে, কি করে রিয়াদ, কোনোদিন জানতে পারে নি। জানতো শুধু বাড়ির লোক।
রোজ সন্ধ্যায় যখন দেয়ালের ঘড়িতে ছয়টার কাটা ছুঁয়ে যায় তখন বেরিয়ে পড়ে রিয়াদ। জাহাজকোম্পানি মোড়ের ‘মনি লাইব্রেরী’ তে কাজ করে রাত আটটা পর্যন্ত। তারপর গুপ্তপাড়ায় দুটো টিউশনী করিয়ে বাড়ি ফেরে, ক্লান্ত শরীরে। ঘড়ি কাটার তো বিরক্তি নেই, বিরতি নেই; তাই ততক্ষণে ঠিকঠাক রাত বারোটা বেজে যায় দেয়ালঘড়িটায়। ঠিকঠাক থাকে না শুধু বাড়িটা। মাস শেষে টাকা পায় বলেই সমস্যা রিয়াদের।
একবারে টাকাগুলি মায়ের হাতে তুলে দেয় প্রতি মাসে। তবুও মাসের পনেরো দিন না যেতেই টাকা শেষ। বোনদের পড়ার খরচ, বাড়ির নিত্য খরচ; সব মিলিয়ে ফুরিয়ে যায় টাকা। ধার করেও
সামলে উঠতে পারে না রিয়াদ। মা অন্য বাড়িতে কাজে যেতে চায়। কিন্তু, সেটা কড়া করে নিষেধ
করেছে রিয়াদ। বাবা তো সব সময় কাজও করতে পারে না। বয়স বাড়ছে। সংসারে অশান্তি তাই লেগেই থাকে। এসব শুনলে কি মাহিয়ার মনে মায়া হত, নাকি করুণা? মহাদেব সাহার মতন রিয়াদ তো করুণা চায় না, সে চায় ‘ভালোবাসা’। কারণ, ভালোবাসার জন্মস্থান যদি করুণা হয়; তবে সে ভালোবাসায় কোনো গভীরতা থাকে না। রিয়াদ চাকরির কথাও ভাবে। একটা কোম্পানিতে আলাপ হয়ে আছে, মাস্টার্সটা শেষ হলেই জয়েন্ট। হাজার কুড়ি সেলারি। তখন আর এত অভাব থাকবে না। মাহিয়ার মান তখন ঠিক ভাঙবে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে যে কখন মঠভাঙা দিঘি হাতের বামে রেখে শেঠিয়ার মোড় চলে এসেছে রিয়াদ, খেয়ালই করে নি।
মোড় থেকে পূর্বদিকে হাঁটছে রিয়াদ। পথ যেন আজ ফুরাতে চাচ্ছে না। হাতের ডানে ‘নিরঞ্জন মিষ্টিমুখ’। এ অঞ্চলের বিখ্যাত মিষ্টি দোকান। নিবারণচন্দ্রের ছেলের দোকান বলে কথা। মাহিগঞ্জে মিষ্টি-ব্যবসা তো তারাই শুরু করেছিল। রংপুরে এসে যদি কেউ নিরঞ্জনের মিষ্টি না খায়, তার রংপুর আসাটাই বৃথা।
প্রথম ওদের বাড়িতে যাচ্ছে রিয়াদ। হবু শ্বশুর পেশায় কসাই, স্বভাবেও। রিয়াদ মিষ্টি নিল কিছু। আর কিছু পুরি। মিষ্টি দেখে যদি ভাল আচরণ করে। হা,,হা।
বৃষ্টিটা একটু হালকা হতে শুরু করেছে। মাহিয়াদের বাড়ি কাজীটারি। গোসাইবাড়ি মন্দিরটা পেরিয়ে কলেজের পেছনে দিয়ে যে রাস্তাটা পূর্বে গেছে ওটাই গোসাইবাড়ি রোড। রোডটা কিছু দূর এগিয়ে গেলে কাজীটারি।
বৃষ্টিভেজা গোসাইবাড়ির মঠগুলি অনন্তযৌবনা হয়ে উঠেছে। হঠাৎ কেউ দেখলে ভাবতে পারে নেপালে এসেছে সে। দুর্দান্ত, নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত মঠগুলি ১২০১বঙ্গাব্দের তৈরী। এর আশপাশে গোসাই মহারাজের বংশধররা বসবাস করে এখনও। রিয়াদ গোসাইবাড়ি পেরিয়ে সামনে দু’পা ফেলতেই বন্ধু বিশেষের সাক্ষাত মেলে।
রিয়াদকে এ বৃষ্টিতে দেখে অবাক ও। আরোও কি একটা অনুভূতি কাজ করছে বিশেষের মাঝে তাৎক্ষণিকভাবে সেটা আন্দাজ করতে পাচ্ছে না রিয়াদ।
-কিরে রিয়াদ, তোর ফোন বন্ধ ক্যান? আর এদিকে যাচ্ছিস যে!
-ফোনে চার্জ নেই। আর এদিকে যাচ্ছি তো কি হইছে?
-সে জন্যই তোকে ফোন দিচ্ছিলাম।
–ক্যান কি হইছে বলতো? মাহিয়ার কোনো.. বলতে গিয়ে থমকে গেল রিয়াদ। এ কথাটুকু
শোনামাত্র হুু হু করে কাঁদে উঠল বিশেষ।
-মাহিয়াকে কারা যেন খুন করেছে। -একথা শোনার জন্যি মোটেও প্রস্তুত ছিল না রিয়াদ। গগণবিদীর্ণ করে একটা চিৎকার দিল যেন সে! পরিস্থিতি ভাষায় বলার মত না। মনে হয় বুকটা ফেটে গেল ওর। রিয়াদের মুখ চেপে ধরল বিশেষ। সবার সন্দেশের তীর রিয়াদের দিকে।
-চুপ কর দোস্ত। তোকে ওপাড়ার কেউ দেখলে পুতে ফেলবে। সাংবাদিক, পুলিশে ভেসে গেছে
ওখানে। তুই পালা। –কথা শেষ হয় না, কয়েকজন লোক রিয়াদকে ধরে ফেলে। একটা লাঠির আঘাত পড়ে রিয়াদের মাথায়।
দুইদিন পর।
রংপুর ধাপ জেলখানার সকাল, সূর্যালোক উকি দেয় একটু একটু। জ্ঞান ফিরেছে রিয়াদের। সকালে রংপুর মেডিকেল থেকে জেলে আনা হয়েছে। চোখ মেলে ভাই, বোন, মা, বাবা, রিপন,বিকাশ, বিশেষদের দেখছে রিয়াদ। অঝরে কাঁদছে মা, কাঁদছে রিয়াদও।
‘ডি.এন.এ রিপোর্ট ও সিআইডি বলছে- মাহিয়াকে ধর্ষণের পর ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ছুরিটা মাহিয়ার ঘরেই ছিল আগে থেকে। সেখানে রিয়াদের সম্পৃক্তার আলামত নেই। মুখ হাত বাঁধা ছিল মাহিয়ার। ঘরে ওসমানের মোবাইল, স্যান্ডেল আর শার্ট পাওয়া গেছে। ওসমান কলকাতায় পালিয়েছে। র্যাব-১৩ তিনদিন সময় চেয়েছে ওসমানকে ধরার জন্য।’ বিকাশ বলল কথাগুলি।
মিনিট দশ পরে লকাপ খুলে দেয়া হলো।
বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই ছুটে গেল মাহিগঞ্জে, মাহিয়ার কবরের কাছে। একটা সোনালুগাছের চারা আর একটা বকুলের চারা লাগানো কবরটায়। বৃ্ষ্টির পানিতে ভিজে যাচ্ছে চারাগুলি। দু’চোখ বেয়ে বৃষ্টি ঝরছে রিয়াদের।
দুই.
পাঁচ বছর পর, আজও আষাঢ়ের বৃষ্টি। সোনালু ফুল ফুটেছে। বন্ধুদের অনেকেই কলেজে এসেছে কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। সবাই কেমন বদলে গেছে! সবকিছুই যেন বদলে গেছে। কলেজের দেয়ালের রঙ বদলেছে, কলেজর প্রধান ফটকটি নতুন করে তৈরি করা হয়েছে, নতুন একটা ভবন উঠেছে; স্যার-ম্যামদের মধ্যে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন। আর সবার মতন রিয়াদও এসেছে, আসে নি শুধু মাহিয়া। স্বার্থপরের মত রিয়াদকে রেখে একলা ঘরে ঘুমোচ্ছে সে।
আচ্ছা,,, ওপার থেকে রিয়াদের কান্না কি শুনতে পারে সে? অনেকবার ভোলার চেষ্টা করেছে মাহিয়াকে। কিন্তু, পারে নি। আসলে কাউকে ভুলে যাওয়া যতটা কঠিন, তারচে’ কঠিন কাউকে ভালোবাসা। কারণ, যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ভোলা যায় না।
আষাঢ় যায়, আষাঢ় আসে; সোনালু ফুল ফোঁটে, আবার ঝরেও যায়; রিয়াদের চোখেও আষাঢ় নাবে, তবে বছরে বছরে নয়, যখন তখন; ভীষণ পোড়ায় সেই আষাঢ়সুখ।