অস্পৃশ্য বন্ধন
মাসুদ বশীর
ঝিরঝির হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো দুলছে, মনে হচ্ছে দখিনা হাওয়া কথা বলছে। পাতাগুলো নড়েচড়ে হাসছে, করছে কথোপকথন। অনির্বাণ কর চেয়ে আছে অপলক। হাওয়ার খেলায় তার মনের মাঝে জেগে উঠলো অন্য আলাপ। বাতাসের তোড়ে হঠাৎই একটা শুকনো পাতা হাওয়ায় ভেসে ভেসে মাটিতে শুয়ে পড়লো। অনির্বাণের বুকটা ধরাস করে কেঁপে গুমরে উঠলো ব্যথায়। গাছ থেকে পাতার বিচ্ছেদের দৃশ্যে মনে পড়ে গেল তার হারিয়ে যাওয়া বুকের মানিকের বিষাদময় বিদায়ের কথা।
এমনি হাওয়ার মতো অদেখা স্পর্শে একদিন বিদায় নিয়েছিল তার অপরূপা সুন্দরী কন্যা-সন্তান।
অদেখা স্পর্শে কতকিছুই তো ঘটে যায়। বুকের ব্যথাটা হালকা করতে অনির্বাণ তার হাতে থাকা এন্ড্রয়েডে ফেসবুকে মনোনিবেশ করে, হঠাৎই একটা পোস্টে তার চোখ আটকে যায়। তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের নামের সাথে পোস্টের নামটি প্রায় মিলে গেছে। সে তৎক্ষনাৎ কমেন্ট লিখে পোস্ট দিলো এভাবে- “আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের নামের আদ্যাক্ষরের সাথে নামটি মিলে গেছে। শুভকামনা রইলো।”
কিছুক্ষণ বাদ ওপার থেকে ফিরতি কমেন্ট এলো- “আপনি চাইলে আমাকে ঐ নামেই ডাকতে পারেন” এমন বার্তা পেয়ে অনির্বাণের চোখে জল চলে এলো- ‘আনন্দাশ্রু’।
আবারো ফিরতি বার্তায় তাদের দুজনের মধ্যে ‘বাবা-মেয়ে’ এমন একটা পবিত্র সম্পর্কের সৃষ্টি হয়ে গেলো।
অনির্বাণ মনের গভীরে পবিত্রভাবে ধারণ করে নেয় যে, সে তার হারিয়ে যাওয়া বুকের ধনকে ফিরে পেয়েছে। এভাবেই চলছে এখন তার দিনকাল…
কি এক অদ্ভুত অস্পৃশ্য টানে সেই হাজার মাইল দূরে থাকা অন্য মানচিত্রের একজন কে সে প্রায়শই ভাবে আর তার মনের মাঝে জমে থাকা হাজারো না বলা কথাগুলো বলার জন্য সর্বদা উদ্বেল হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বুকের মাঝে সে তার মেয়ে কে ভাবনায় জড়িয়ে ধরে আদর করে।
তার মেয়ে কবিতা আবৃত্তি করে, অনির্বাণের বুকটা ভরে যায়। অনির্বাণও অল্প-বিস্তর লেখালেখি করে। হাজার মাইল দূরের তার মেয়ে তার কবিতা আবৃত্তি করে। অনির্বাণ খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়, সর্বদা শুধু সে তার ফিরে পাওয়া মেয়ে কে “মা মা” বলে ডাকে এবং হাজার মাইল দূরের তার মেয়েও তাকে সম্মানে, আদরে ভরিয়ে দেয়।
অনির্বাণ যেন তার মেয়ে কে ফিরে পেয়ে নতুন জীবন পেয়েছে, সে তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে এবং ফেসবুকে পোস্ট দেয়, আর হাজার মাইল দূরের তার মেয়ে আনন্দে-আনন্দে কমেন্ট করে।
বিধাতার কি এক অস্পৃশ্য-অদ্ভুত সুন্দর খেলা, কোনদিন সামনা-সামনি যার সাথে দেখা হলোনা কোন কথা হলোনা, অথচ দুটি নিষ্পাপ প্রাণের কি এক মায়াভরা পবিত্র বন্ধন তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
অনির্বাণ কর, সর্বদা আলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকে হাজার মাইল দূরের তার মেয়ে, যাকে সে মা বলে ডাকে তার জীবনের মঙ্গলের জন্য- মেয়ের পথের সমস্ত অন্ধকার কে দূরীভূত করতে।
এ যেন এক বাবা-মেয়ের অস্পৃশ্য পবিত্র মায়াবী বন্ধন। তাদের দুজনের সামনাসামনি দেখা হবেনা হয়তো কোনদিনও, কিন্তু এই পবিত্র অমায়িক মধুর বন্ধন অটুট থাকবে অনাদিকাল এবং অনন্য সুন্দর সম্পর্কের কথা লিখে রাখবে নিশ্চিত কালের ইতিহাস।