অন্যরকম ঈদ
এটিএম মোর্শেদ
রাতে খুব ভালো ঘুম হয়েছে ইমু’র, ইমু মানে ইসরাত জাহান। বাড়ির সবাই তাকে ইমু বলেই ডাকে। রাতে খুব মজার একটা স্বপ্ন দেখেছে সে, বৃটেনের রাজকুমারীর মতো সেজেগুজে বসে আছে সে আর অসংখ্য নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে আনন্দ করছে। একটা প্রচ্ছন্ন ভালোলাগায় এখনও মনটা ভরে আছে তার।
সকাল প্রায় দশটা, তবুও বিছানা না ছেড়ে সে অদূর ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্ন দেখছে আর বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই ঈদ, অবশ্য সেটা বড় কথা নয়, এই পঁচিশ বছর বয়সে তার জীবনে অনেক ঈদ এসেছে ঈদে কম- বেশি আনন্দ উৎসবও করেছে কিন্তু এবারের ঈদটা আসছে একটু অন্যভাবে যে!
ঈদের আগেই আশিক আসবে এক মাসের ছুটি নিয়ে। ঈদের দুএকদিন আগে কিংবা পরে আশিকের সাথে বিয়ে হবে তার, তবে ঈদের আগে অর্থাৎ রমযান মাসে সাধারণত বিয়েশাদির অনুষ্ঠান খুব একটা হয় না তাই ধরে নেয়া যায় ঈদের দুদিন পরেই হবে।
আশিক তরুণ ডাক্তার, পোস্টিং বেশ দূরে। মেঝো ভাবির খালাতো ভাই। মেঝো ভাবির সাথে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে মাস দুয়েক আগে তার সাথে পরিচয়। মেঝো ভাবির মাধ্যমেই পারিবারিক ভাবে আলোচনার মাধমে বিয়ের সম্মন্ধ পাকা হয়ে আছে।
পাত্র হিসাবে আশিক সব দিক থেকেই উপযুক্ত, সুদর্শনও বটে। ইমুর খুব পছন্দ হয়েছে।
এই মুহূর্তে ইমুর ভীষণ ইচ্ছে করছে আশিককে একটা ফোন দেয়ার কিন্তু দিল না কারণ, মেঝো ভাবি বলেছে “ছেলেদের কখনও বুঝতে দিতে নাই, খুব ভালোবাসি। এতে তারা বেঁকে যায়। দিনে একবারের বেশি ফোন দিলে তখন সে ফোন না করে তোর ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকবে। এতে তার দামটা বেড়ে যাবে আর তোরটা কমবে। বুঝলি?”
ইমু ভাবে, মেঝো ভাবি সত্যিই একটা জিনিয়াস, ছেলেদের হাড়ে হাড়ে চেনে। তানাহলে মেঝো ভাইয়ার মতো রাশভারী, মেজাজি লোকটাকে বগলদাবা করল কিভাবে?
এমন সময় ইমুর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো, ওপাশ থেকে আশিকের কন্ঠ : গুড মর্নিং, মহারানীর ঘুম ভেঙ্গেছে?
ইমু : দুই ঘন্টা আগে
আশিক : তাহলে ফোন দাওনি কেন?
ইমু : তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম, তোমার বাড়ি আসার ডেট ঠিক আছে তো?
আশিক : অবশ্যই, এখনও তিন দিন বাঁকি মন বলছে এক্ষুনি উড়াল দেই
ইমু : এতো অধৈর্য হইও না আর এবার এসে কোনো প্রকার অসভ্যতা করবে না কিন্তু বলে বলে রাখছি।
ইমু নিজের বাম গাল টা ছুঁয়ে রোমাঞ্চিত হয় আর মনে মনে হাসে।
আশিক : দুষ্টুমি নাহয় নাই করলাম, নিজের বৌয়ের সাথে মজা করতে পারবো তো?
ইমু : আগে বিয়েটা তো হোক, তারপর দেখা যাবে।
এরকম আরও অনেক কথার পর একসময় আশিক ফোনটা কেটে দিল।
রাতে শুয়ে শুয়ে ইমু ভাবে, সত্যিই আমি খুবই সুখী, স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম। দুঃখ কষ্ট কাকে বলে কোনোদিন বুঝিনি, বাবা মা ও ভাইদের পরম আদরে বড় হয়েছি, লেখাপড়া শিখেছি। কজন মেয়ের ভাগ্য হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করার? আমি তাও করেছি অথচ আমাদের চারপাশের কত মানুষ ভালোভাবে লেখাপড়া তো দূরের কথা প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত ঠিকমতো পাচ্ছে না।
সমাজের বিত্তবানদের উচিত এদের প্রতি একটু সহানুভূতির হাত বাড়ানো।
ইমু অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। মনে মনে সে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়।
পরদিন সকালেই বাড়ির পুরোনো কাজের লোক রমিজ চাচাকে বলে, চাচা আমাদের মহল্লার সবকটি গরীব পরিবারের একটা তালিকা তৈরী করবেন আর ছোট্ট ছোট ছেলেমেয়েদের নাম ও বয়স লিখেআনবেন।
রমিজ চাচা বলেন, ওসব করে কি হবে? ওসব তো সরকারি কাম। ইমু একটু নরম সুরেই বলে, আমি যা বললাম আপনি কালকের মধ্যে তাই করে আনবেন, কারণ টা পরে বলব আপনাকে।
আশিক পরদিন ফোন করে ইমুকে জিজ্ঞেস করে, ঈদে তোমার জন্য কি কি নিয়ে আসব?
ইমু : আমার জন্য কিছুই আনতে হবে না, তোমার সাথে কথা আছে যদি কিছু কিনতে হয় আমরা এখান থেকেই কিনব।
ঈদের সপ্তাহ খানেক আগেই আশিক বাড়িতে চলে আসে এবং শপিংয়ে যাওয়ার জন্য ইমুকে তাগাদা দিতে থাকে।
ইমু : কত টাকা শপিং করবে?
ইমুর এমন কথায় আশিক ভীষন অবাক হয়, বুঝতে পেরে ইমু বলে, আমাকে ভুল বুঝো না। এক্ষুনি তোমার ভুল ভেঙ্গে যাবে, শুধু বলো কত টাকা?
মন খারাপ করে আশিক বলে ধরো ত্রিশ হাজার।
ইমু : সমস্যা নাই, যথেষ্ট। আমরা বিশ হাজার টাকা আমাদের ঈদ শপিং করবো আর বাঁকি দশ হাজার টাকায় এলাকার গরীব মানুষদের জন্য খরচ করবো, তোমার আপত্তি আছে?
আশিক : মোটেও না তবে তোমার এমন চিন্তা ভাবনার জন্য আমি ভীষণ আনন্দিত এবং গর্বিতও বটে। সামনের ঈদে আমিও আমার এলাকার গরীবদের জন্য এমন একটা ব্যবস্থা করবো। তোমার কাছথেকে বিরাট একটা শিক্ষা পেলাম, সত্যিই তুমি একটা লক্ষী মেয়ে।
ইমু তার বাবার বাবার কাছেও ঈদ উপলক্ষে বিশ হাজার টাকা নিয়ে অর্ধেক টাকা নিজেদের জন্য এবং বাঁকি অর্ধেক গরীবদের জন্য মোট বিশ হাজার টাকায় শাড়ি, লুঙ্গি এবং ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য জামা কাপড় কিনে ঈদের আগেই তা বিতরণ করে দেয়।
ঈদে এলাকার গরীব দুঃখীদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।
ঈদের ঠিক দুদিন পরেই ইমু এবং আশিকের বিয়ে হয়ে যায়। আনন্দ উৎসব ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামময়,
গ্রামের নারী পুরুষ সবাই এসে ইমুর পরম আয়ু কামনা করে, বড়রা ইমুর মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করে ছোটরা পায়ে হাত রেখে সালাম করে। কেউ কেউ বলে, আমাদের ইমু মাকে দেখে রাণীর মতো লাগছে।
অতপর, অদ্ভুত অবর্ণনীয় সুন্দর একটা ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে ইমু শ্বশুর বাড়ি চলে যায়।