অচ্ছুত
মুকুল রায়
ফ্ল্যাটের রুমের বন্ধ দরোজায় ঠকঠক করে শব্দ করে সৌরভ। কিছুক্ষণ পর বউ দরোজা খোলে। তার হাতে থালা। তিনি ঠিকই জানেন- এখন তাকে রুটি দেবার সময়!
করোনার আন্তর্জাতিক মহামারী প্রকোপের টালমাতাল এই চরম ভীতিকর সময়ে একটু জ্বরজ্বর আর গলাব্যথার ভাব হওয়ায় সাবধানতার পদক্ষেপ হিসেবেই তার বউয়ের এই স্বেচ্ছা-‘কোয়ারান্টাইন’! আর সেই কোয়ারান্টাইনের নিয়ম মোতাবেক ফ্ল্যাটের এককক্ষে বন্দীর মত জীবনযাপন করছে তিনি। ফ্ল্যাটটির এই একটি রুমের দরোজা সবসময় বন্ধ থাকে। শুধুমাত্র সকালের চা-নাস্তা, দুপুরে ভাত, আবার বিকেলে চা-বিস্কুট এবং রাতের খাবার দেবার সময়ে এসব নেবার জন্যই যা একবার করে দরোজা খুলে যায় মাত্র।
অবশ্য করোনা-মুক্তির ঔষধ হিসেবে আরও চার-পাঁচ বেলা নব-আবিস্কৃত অদ্ভুত ধরণের একটি রসায়ন দেয়া হয় ওনাকে। আর আদা-গুলমরিচ-লঙ-কালোজিরা ইত্যাদির সিদ্ধ করা গরমজলে লেবুর রস মিশ্রিত সেই রসায়ন মগে ঢেলে নেয়ার ঐ কয়েক সেকেন্ড সময়টুকুর জন্যও বন্ধ দরোজা অতিরিক্ত আরও কয়েকবার খুলে যায় প্রতিদিন।
কোথা থেকে যে এক অদ্ভুত রহস্যময় রোগ এলো এই ‘করোনা’! সারা পৃথিবী টালমাটাল! পৃথিবীজুড়ে রোল উঠে গেল- করো না, করো না করো না… এটা করো না, ওটা করো না, সেটা করো না..! লোকজনের সাথে মেলামেশা করো না। এ বাসা ও বাসা যাওয়া আসা করো না। তোমার বাসাতেও অন্যদের এলাউ করো না। ভীড়ের মধ্যে যাতায়াত করো না। বাজারঘাটে যাতায়াত করো না। রাস্তাঘাটে হাঁটাহাঁটি করো না। লেকের ধারে গিয়ে ব্যায়াম করো না…! জ্বর জ্বর ভাব থাকলে, সেই সাথে গলাব্যথা হলে রুমের মধ্যে একা একা বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘কোয়ারেন্টাইন’-এ থাকো, পরিবারের অন্যেদের মাঝে নিজেকে বের করো না! এমন কি স্বামীর সাথেও এক বিছানা তো দূরের কথা, একরুম ব্যবহার পর্যন্ত করো না…!
বউয়ের সেই কোয়ারেন্টাইনের দ্বিতীয় দিন সকালে ভেতরে রাখা প্লেট এবং কাপে প্রথম রুটি-চা দিতে গিয়ে সৌরভ যেন একটি ধাক্কা খেলো। দরজা খোলার পরে সৌরভ বউয়ের জন্য নেয়া রুটি হাতে নিয়ে থালায় দিতে গেলো। কিন্তু রুটি থালা স্পর্শ করার আগেই থালাটি একটু নিচে সরিয়ে নিয়ে মাস্ক পরা মুখে চাপা স্বরে বউ সাবধান বাণী উচ্চারণের মত বলে ওঠে- ‘থালায় হাত লাগিও না, থালা ছুঁয়ো না!.. উপর থেকে ছেড়ে দাও!’
প্রথম দিন থালাপ্লেট, গ্লাস এবং কাপসহ নাস্তা, খাবার এবং চা দেয়া হয়েছে। রুমের মধ্যেই সেসব থাকবে। বউ সেসব পরিষ্কার করে তার রুমেই রেখে দেবে, ওসব আর বাইরে আসবে না। দ্বিতীয় দিন ঐসব থালাপ্লেটেই খাবার তুলে দেয়া হবে- এই ছিল সাবধানতার সিদ্ধান্ত! সেই প্লেটে খাবার তুলে দিতে গিয়ে দ্বিতীয় দিন সকালেই এই ছন্দপতন!
একটু হতচকিত সৌরভ থমকে যায়! তারপর থালা স্পর্শ না করে থালা থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে উপর থেকে রুটি ছেড়ে দেয় বউয়ের হাতের থালায়। এরপরে বাটি থেকে ঢেলে দেয় সবজি। নরম সবজি উপর থেকে থালায় পড়ে থপ করে এলিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে আবার দরোজায় শব্দ করে সৌরভ। ভেতর থেকে হাতে খালি কাপ নিয়ে দরোজা খুলে দাঁড়ায় বউ! এবং বোকাসোকা স্বামীর উদ্দেশ্যে আবারও সেই সাবধানী উচ্চারণ- ‘কাপে কাপ লাগিও না!’ সৌরভও যথারীতি তার হাতে ধরা চায়ের কাপটি কাত করে রুটি দেবার মতইএকটু দুরত্ব বজায় রেখে উপর থেকে চা ঢেলে দেয় বউয়ের কাপে!
কদিন ধরে এসব করতে করতে হঠাৎ করে আজ কেন যেন অনেক আগের স্কুল এবং কলেজে পড়ার দিনগুলোর দুটি দৃশ্য তার মানসচোখে ভেসে ওঠে! সেই ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময়ে টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের কাছে কুলাঘাট বাজারের চায়ের দোকানে টিফিন খেতে যেত। এরকম একদিন টিফিন খেতে গিয়ে দেখলো- শিবদাশ কাকু বাজারের ঝাড়ুদার মনভোলার হাতে ধরা কাপে চা ঢেলে দিচ্ছেন কাপ দুরত্ব বজায় রেখে । এই দৃশ্যের সাথে ভেসে ওঠে আর এক দৃশ্য! রংপুর কারমাইকেল কলেজে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে শহরের নিপেনের মোড়ের নৃপেনবাবুর চায়ের দোকানে চা খেতে বসে এক সকালে দেখে- দোকানের কর্মচারী দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু পুরুষ ও মহিলা মেথরকে চা ঢেলে দিচ্ছে। মেথরদের হাতে ধরা পৃথক গ্লাসে চা ঢেলে দেবার দুই দৃশ্যেই ক্রিয়াশীল একই মানসিকতা- দুরত্ব বজায় রেখে সাবধানে অচ্ছুতদের শারীরিক স্পর্শই শুধু নয়, তাদের হাতে ধরা পাত্রের পর্যন্ত স্পর্শ এড়িয়ে ওদের পাত্রে চা ঢেলে দিচ্ছেন তারা .. .!